শিরোনাম :
Logo ‘মার্চ ফর গাজা’ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ Logo আউটসোর্সিং সেবা গ্রহণ নীতিমালা জারি Logo বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: সেলিম উদ্দিন Logo কুয়েটে বহিষ্কারাদেশ থেকে নির্দোষ শিক্ষার্থীদের অব্যাহতির দাবি শিবিরের Logo আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাই প্রথম সংস্কার, বললেন ববি হাজ্জাজ Logo নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য কয়টি সন্তান ভালো, যা বলছেন গবেষকরা Logo সানস্ক্রিন নাকি ময়েশ্চারাইজার, প্রথমে কোনটি মাখা উচিত Logo শত শত নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন চাঁদপুরের বিজয়ী কন্যা তানিয়া ইশতিয়াক খান Logo সাড়া ফেলেছে জুলাই বিপ্লব নিয়ে রাবি শিক্ষার্থীর নির্মিত শর্টফিল্ম ‘মাদারল্যান্ড অর ডেথ ‘ Logo আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে চাঁদপুর জেলা কারাগারে বাংলা নববর্ষকে বরণ

এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:০২:৫৩ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫
  • ৭৪৩ বার পড়া হয়েছে
|| রেজাউ করিম খোকন ||

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার চিন্তা থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরেই এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের দিন ঠিক আছে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। বিষয়টিকে আরো পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) এই ভাবনার কথা বলেছিলেন। তখন জানানো হয়েছিল, উত্তরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি করা হয়েছে। ২০২৬ সালেই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে, তা মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই উত্তরণে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে।

এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসঙ্ঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পর পর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরো দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তা হলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে। ২০২৬ সালেই এলডিসি উত্তরণ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। এখন উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশল ঠিক করা আছে। প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষায়। এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। এতে নির্বাচন-পরবর্তী সরকার তাদের মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও এক ধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় আছে ছয়টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরো দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ। এলডিসি থেকে বের হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং আগের চেয়ে বাড়বে এবং এখনকার চেয়ে কম সুদে ঋণ পাওয়া যেতে পারে। আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে আরো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। এর ফলে রফতানি বিশেষত, তৈরী পোশাক ফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে প্রাধিকার থাকবে না। ওষুধ শিল্প পেটেন্ট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে এতদিন যে অব্যাহতি পেয়ে আসছে, তা থাকবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক নীতিগুলো পালন করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বাংলাদেশকে একটি উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের এ অর্জন বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং আরো অধিকতর উন্নয়নের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে।

প্রস্তুতিকালে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা এতদিন পেয়ে আসছিল, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এলডিসি উত্তরণে পণ্য রফতানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইস্যুতে ওষুধশিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। বেড়ে যাবে ওষুধের দাম এবং এতে রফতানি বাজারও কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজ শর্তের ঋণ ও অনুদান সহায়তা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রফতানি পণ্য ও শিল্পে ভর্তুকি দেয়ার সুবিধা হ্রাস করতে হবে। কিছু কিছু কৌশল নেয়া হলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে। তবে দেশের প্রধান রফতানিপণ্য তৈরী পোশাক রফতানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্মপরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল নেয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। তবে সুযোগও তৈরি হবে অনেক। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে হলেও ঋণ নিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক খরচ করা সম্ভব হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের জন্যও এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেক সমস্যা তৈরি হবে, এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রফতানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। রফতানি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া যেমন গৌরবের, তেমনি তা চ্যালেঞ্জেরও বটে। বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায়, তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে। রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নতুন কিছু শর্ত পরিপালনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে থাকতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই জিএসপি প্লাস প্রাপ্তির শর্তগুলো পূরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বিদেশী প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে আমদানি-রফতানি-করনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। চাপে পড়ে হলেও এসব নীতি-সংস্কার আখেরে আমাদের জন্য ভালো হবে। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের কারখানাগুলোকে অনেকটাই পরিবেশ ও শ্রমিকবান্ধব করতে পেরেছি। তবে বাদবাকিদেরও একই মানের হতে হবে। সবুজ জ্বালানির ব্যবহার, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমাদের শিল্প-কারখানাকে আরো আধুনিক ও মানবিক করার তাগিদ বাড়বে। প্রতিযোগী মূল্যে পণ্য রফতানির জন্য এই পরিবর্তন অপরিহার্য হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো স্মার্ট করতে হবে। নতুন করে বিশ্ব বাণিজ্যনীতিতে যেসব পরিবর্তনে আমাদের সায় দিতে হবে তাতে কোনোরকম হেলাফেলা চলবে না। মনে রাখতে হবে যে, এলডিসি হিসেবে এত দিন মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, আইসিটি ও সেবা খাতে বিশেষ বিশেষ যেসব সুবিধা পেতাম, উত্তরণের পর সেসব উঠে যাবে। আমাদের ওষুধশিল্প ২০৩৩ পর্যন্ত উন্নত বিশ্বে শুল্কবিহীন সুবিধা পেতে থাকবে। ওই সময় পর্যন্ত আইপিআরের শর্তগুলোও শিথিল থাকবে। প্রযুক্তি ও কাঁচামালও আমরা সহজ শর্তে আমদানি করতে পারব। এর পর আমাদের নিজস্ব গবেষণা, পেটেন্টসহ উন্নততর বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। গার্মেন্টস খাতেও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু শুল্ক দিয়েই আমরা আরএমজি রফতানিতে আমাদের শক্তিমত্তা দেখাচ্ছি। জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে খুব একটা সহায়তা না পেলেও নিজেদের অর্থ খরচ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে যেসব বৃত্তি, অনুদান আন্তর্জাতিক ও উন্নত দেশ থেকে পেয়ে থাকি, সেসব হয়তো কমে যাবে। তবে দরকষাকষি করে খানিকটা রক্ষা করাও সম্ভব। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদের হার খানিকটা বাড়াবে। এ প্রক্রিয়া এরই মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে।

কৃষি ও রফতানিপণ্যের বহুমুখীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিশ্চয় আমরা উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম। অবকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যবসার পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়িয়ে নিশ্চয় শুল্ক দিয়েও আমাদের পণ্যকে বিশ্বে প্রতিযোগী করে তুলতে পারি। তাই এখন আমাদের নতুন পণ্য, নতুন বাজার এবং উৎপাদন পদ্ধতিকে আধুনিক করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা যদি আগামী দিনে জ্ঞানভিত্তিক ও সবুজ অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিই এবং সে জন্য কাক্সিক্ষত মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে পারি, তা হলে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে জোরকদমে। এ ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিই সবচেয়ে বড় কথা। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ধারার সূচনা করেছি তা শুধু অক্ষুণ্ন নয়, আরো গতিময় করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমনটি করেই আজ উন্নত দেশ। ভিয়েতনামও সেই পথে হাঁটছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং চীনও একই পথের যাত্রী।

আমরা এখন আর কতই বা অনুদান ও রেয়াতি সুদে বিদেশী ঋণ নিই? প্রায় সব ঋণই তো ‘নন-কনসেশনাল’ হয়ে গেছে। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবেই বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতির মাঠে খেলতে হবে। চীন থেকে অনেক বিদেশী উদ্যোক্তাই ‘রুলস অব অরিজিন’-এর সুযোগ নেয়ার জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ থেকেই বিদেশীরা তাদের পণ্য রফতানি করবেন। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এসব পণ্য রফতানি থেকে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ যেন বাংলাদেশেই পুনর্বিনিয়োগ হয়। আমাদের মধ্য ও উচ্চ আয়ের মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তাদের উচ্চমানের পণ্যের ভোগের চাহিদাও বাড়ছে। বাড়ন্ত এই অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে নিশ্চয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও মনোযোগ রয়েছে। তাই আমাদের দেশীয় বাজারেও প্রযুক্তিনির্ভর নয়াপণ্যের বিকিকিনি বাড়বে। আমাদের তাই দ্রুতই ‘নিট আমদানিকারক’ দেশের পরিচয় ঘুচিয়ে আরো আমদানিবিকল্প এবং রফতানিমুখী শিল্প গড়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ বাড়িয়ে যেতে হবে। রফতানিপণ্যের কাঁচামাল আমাদের দেশেই দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা আমাদের ইপিজেড, বেজা, বেপজা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন করবেন সেই সক্ষমতা অর্জনের দিকেই আমাদের নীতি-মনোযোগ বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে আমরা সিমেন্ট, পেট্রো কেমিক্যাল, উন্নতমানের বড় সুতা উৎপাদনে প্রভূত উন্নতি করেছি। এসব সহায়ক শিল্পের উন্নয়নে একদিকে দেশী বাজার ও শিল্পায়নের জন্য কাঁচামালের চাহিদা মিটছে, অন্যদিকে আমাদের প্রতি ইউনিট রফতানি আয় থেকে মূল্য সংযোজনও বাড়ছে। এভাবেই আমাদের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সেøাগানটিকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে হবে।

আমাদের উন্নয়নের এই ধারাকে আরো বেগবান করতে তাই সরকারকে অবারিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবহন, দক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সক্রিয় ব্যক্তি খাতকে আরো দক্ষ করার জন্য ব্যবসায় সহায়ক নীতি, তথ্য, আর্থিক খাতের আরো আধুনিকায়ন ও সুশাসন এবং সর্বোপরি মহামারী-উত্তর নয়া পৃথিবীতে নিজেদের শক্তিমত্তা বজায় রাখতে সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের কৌশলকে আরো জোরদার করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের আরো ব্যাপক হারে সম্পদের সমাবেশ ঘটাতে হবে। সে জন্য কর কাঠামোর ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এসবই হবে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বড় সহায়ক। আর কর্মসংস্থান বাড়লেই দারিদ্র্য কমবে। বৈষম্যও কমবে। তা ছাড়া রফতানি খাতে বস্ত্রশিল্পের বাইরের উদ্যোক্তা যেন একইরকম প্রণোদনা পান তা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের উপযুক্ত মানব শক্তি এবং স্মার্ট কূটনীতির প্রসারে যা যা করা দরকার সরকারসহ সব অংশীজনকে নিষ্ঠার সাথে তা করতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে (এলডিসি) উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার পরিকল্পনা বা স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ দিকে এলডিসি উত্তরণকে মসৃণ ও টেকসই করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এসটিএস কর্মকৌশল অনুমোদন ও প্রকাশ করা হয়েছে। এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলডিসি উত্তরণে আমাদের সামনে খুবই কম সময় রয়েছে।

এসটিএস বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে অনেকগুলো উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দায়িত্বও বণ্টন করা হয়েছে। ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব উপকমিটিকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবে। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধা আর থাকবে না। তাই ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ব্যবসায়ীদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সময়সীমা না পিছিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

‘মার্চ ফর গাজা’ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ

এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

আপডেট সময় : ১২:০২:৫৩ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫
|| রেজাউ করিম খোকন ||

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার চিন্তা থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরেই এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের দিন ঠিক আছে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। বিষয়টিকে আরো পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) এই ভাবনার কথা বলেছিলেন। তখন জানানো হয়েছিল, উত্তরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি করা হয়েছে। ২০২৬ সালেই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে, তা মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই উত্তরণে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে।

এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসঙ্ঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পর পর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরো দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তা হলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে। ২০২৬ সালেই এলডিসি উত্তরণ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। এখন উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশল ঠিক করা আছে। প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষায়। এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। এতে নির্বাচন-পরবর্তী সরকার তাদের মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও এক ধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় আছে ছয়টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরো দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ। এলডিসি থেকে বের হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং আগের চেয়ে বাড়বে এবং এখনকার চেয়ে কম সুদে ঋণ পাওয়া যেতে পারে। আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে আরো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। এর ফলে রফতানি বিশেষত, তৈরী পোশাক ফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে প্রাধিকার থাকবে না। ওষুধ শিল্প পেটেন্ট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে এতদিন যে অব্যাহতি পেয়ে আসছে, তা থাকবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক নীতিগুলো পালন করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বাংলাদেশকে একটি উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের এ অর্জন বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং আরো অধিকতর উন্নয়নের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে।

প্রস্তুতিকালে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা এতদিন পেয়ে আসছিল, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এলডিসি উত্তরণে পণ্য রফতানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইস্যুতে ওষুধশিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। বেড়ে যাবে ওষুধের দাম এবং এতে রফতানি বাজারও কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজ শর্তের ঋণ ও অনুদান সহায়তা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রফতানি পণ্য ও শিল্পে ভর্তুকি দেয়ার সুবিধা হ্রাস করতে হবে। কিছু কিছু কৌশল নেয়া হলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে। তবে দেশের প্রধান রফতানিপণ্য তৈরী পোশাক রফতানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্মপরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল নেয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। তবে সুযোগও তৈরি হবে অনেক। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে হলেও ঋণ নিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক খরচ করা সম্ভব হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের জন্যও এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেক সমস্যা তৈরি হবে, এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রফতানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। রফতানি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া যেমন গৌরবের, তেমনি তা চ্যালেঞ্জেরও বটে। বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায়, তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে। রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নতুন কিছু শর্ত পরিপালনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে থাকতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই জিএসপি প্লাস প্রাপ্তির শর্তগুলো পূরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বিদেশী প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে আমদানি-রফতানি-করনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। চাপে পড়ে হলেও এসব নীতি-সংস্কার আখেরে আমাদের জন্য ভালো হবে। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের কারখানাগুলোকে অনেকটাই পরিবেশ ও শ্রমিকবান্ধব করতে পেরেছি। তবে বাদবাকিদেরও একই মানের হতে হবে। সবুজ জ্বালানির ব্যবহার, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমাদের শিল্প-কারখানাকে আরো আধুনিক ও মানবিক করার তাগিদ বাড়বে। প্রতিযোগী মূল্যে পণ্য রফতানির জন্য এই পরিবর্তন অপরিহার্য হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো স্মার্ট করতে হবে। নতুন করে বিশ্ব বাণিজ্যনীতিতে যেসব পরিবর্তনে আমাদের সায় দিতে হবে তাতে কোনোরকম হেলাফেলা চলবে না। মনে রাখতে হবে যে, এলডিসি হিসেবে এত দিন মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, আইসিটি ও সেবা খাতে বিশেষ বিশেষ যেসব সুবিধা পেতাম, উত্তরণের পর সেসব উঠে যাবে। আমাদের ওষুধশিল্প ২০৩৩ পর্যন্ত উন্নত বিশ্বে শুল্কবিহীন সুবিধা পেতে থাকবে। ওই সময় পর্যন্ত আইপিআরের শর্তগুলোও শিথিল থাকবে। প্রযুক্তি ও কাঁচামালও আমরা সহজ শর্তে আমদানি করতে পারব। এর পর আমাদের নিজস্ব গবেষণা, পেটেন্টসহ উন্নততর বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। গার্মেন্টস খাতেও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু শুল্ক দিয়েই আমরা আরএমজি রফতানিতে আমাদের শক্তিমত্তা দেখাচ্ছি। জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে খুব একটা সহায়তা না পেলেও নিজেদের অর্থ খরচ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে যেসব বৃত্তি, অনুদান আন্তর্জাতিক ও উন্নত দেশ থেকে পেয়ে থাকি, সেসব হয়তো কমে যাবে। তবে দরকষাকষি করে খানিকটা রক্ষা করাও সম্ভব। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদের হার খানিকটা বাড়াবে। এ প্রক্রিয়া এরই মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে।

কৃষি ও রফতানিপণ্যের বহুমুখীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিশ্চয় আমরা উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম। অবকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যবসার পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়িয়ে নিশ্চয় শুল্ক দিয়েও আমাদের পণ্যকে বিশ্বে প্রতিযোগী করে তুলতে পারি। তাই এখন আমাদের নতুন পণ্য, নতুন বাজার এবং উৎপাদন পদ্ধতিকে আধুনিক করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা যদি আগামী দিনে জ্ঞানভিত্তিক ও সবুজ অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিই এবং সে জন্য কাক্সিক্ষত মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে পারি, তা হলে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে জোরকদমে। এ ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিই সবচেয়ে বড় কথা। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ধারার সূচনা করেছি তা শুধু অক্ষুণ্ন নয়, আরো গতিময় করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমনটি করেই আজ উন্নত দেশ। ভিয়েতনামও সেই পথে হাঁটছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং চীনও একই পথের যাত্রী।

আমরা এখন আর কতই বা অনুদান ও রেয়াতি সুদে বিদেশী ঋণ নিই? প্রায় সব ঋণই তো ‘নন-কনসেশনাল’ হয়ে গেছে। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবেই বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতির মাঠে খেলতে হবে। চীন থেকে অনেক বিদেশী উদ্যোক্তাই ‘রুলস অব অরিজিন’-এর সুযোগ নেয়ার জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ থেকেই বিদেশীরা তাদের পণ্য রফতানি করবেন। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এসব পণ্য রফতানি থেকে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ যেন বাংলাদেশেই পুনর্বিনিয়োগ হয়। আমাদের মধ্য ও উচ্চ আয়ের মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তাদের উচ্চমানের পণ্যের ভোগের চাহিদাও বাড়ছে। বাড়ন্ত এই অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে নিশ্চয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও মনোযোগ রয়েছে। তাই আমাদের দেশীয় বাজারেও প্রযুক্তিনির্ভর নয়াপণ্যের বিকিকিনি বাড়বে। আমাদের তাই দ্রুতই ‘নিট আমদানিকারক’ দেশের পরিচয় ঘুচিয়ে আরো আমদানিবিকল্প এবং রফতানিমুখী শিল্প গড়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ বাড়িয়ে যেতে হবে। রফতানিপণ্যের কাঁচামাল আমাদের দেশেই দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা আমাদের ইপিজেড, বেজা, বেপজা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন করবেন সেই সক্ষমতা অর্জনের দিকেই আমাদের নীতি-মনোযোগ বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে আমরা সিমেন্ট, পেট্রো কেমিক্যাল, উন্নতমানের বড় সুতা উৎপাদনে প্রভূত উন্নতি করেছি। এসব সহায়ক শিল্পের উন্নয়নে একদিকে দেশী বাজার ও শিল্পায়নের জন্য কাঁচামালের চাহিদা মিটছে, অন্যদিকে আমাদের প্রতি ইউনিট রফতানি আয় থেকে মূল্য সংযোজনও বাড়ছে। এভাবেই আমাদের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সেøাগানটিকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে হবে।

আমাদের উন্নয়নের এই ধারাকে আরো বেগবান করতে তাই সরকারকে অবারিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবহন, দক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সক্রিয় ব্যক্তি খাতকে আরো দক্ষ করার জন্য ব্যবসায় সহায়ক নীতি, তথ্য, আর্থিক খাতের আরো আধুনিকায়ন ও সুশাসন এবং সর্বোপরি মহামারী-উত্তর নয়া পৃথিবীতে নিজেদের শক্তিমত্তা বজায় রাখতে সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের কৌশলকে আরো জোরদার করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের আরো ব্যাপক হারে সম্পদের সমাবেশ ঘটাতে হবে। সে জন্য কর কাঠামোর ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এসবই হবে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বড় সহায়ক। আর কর্মসংস্থান বাড়লেই দারিদ্র্য কমবে। বৈষম্যও কমবে। তা ছাড়া রফতানি খাতে বস্ত্রশিল্পের বাইরের উদ্যোক্তা যেন একইরকম প্রণোদনা পান তা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের উপযুক্ত মানব শক্তি এবং স্মার্ট কূটনীতির প্রসারে যা যা করা দরকার সরকারসহ সব অংশীজনকে নিষ্ঠার সাথে তা করতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে (এলডিসি) উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার পরিকল্পনা বা স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ দিকে এলডিসি উত্তরণকে মসৃণ ও টেকসই করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এসটিএস কর্মকৌশল অনুমোদন ও প্রকাশ করা হয়েছে। এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলডিসি উত্তরণে আমাদের সামনে খুবই কম সময় রয়েছে।

এসটিএস বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে অনেকগুলো উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দায়িত্বও বণ্টন করা হয়েছে। ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব উপকমিটিকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবে। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধা আর থাকবে না। তাই ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ব্যবসায়ীদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সময়সীমা না পিছিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার