নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজে নাশকতার চেষ্টা হয়েছিলো বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও জানিয়েছেন, বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি মনুষ্যসৃষ্ট। এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সাময়িক বরখাস্তকৃত ছাড়াও তদন্তে আরো অনেকের নাম বেরিয়ে এসেছে। তাদের সকলের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনার সঙ্গে বিমানের প্রকৌশল পরিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনেকেই জড়িত। এছাড়া ভিভিআইপি এই উড়োজাহজটি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের উদ্দেশে উড্ডয়নের ২৪ ঘণ্টা আগে এর দায়িত্বে ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন)। তাদের দায়িত্বে অবহেলাও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ওই ফ্লাইটে ভিভিআইপির নিরাপত্তা নিয়ে চরম গাফিলতি করা হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ এবং তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যে সুপারিশ যুক্তিযুক্ত, তা হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট বিষয়টি নাশকতামূলক কি না তা আইনের আওতায় এনে তদন্ত করা এবং আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার জন্য যে শাস্তির বিধান থাকে তা প্রদান। বিমানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আর হতে পারে না। শেখ হাসিনা শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার জীবননাশের জন্য অনেকবার চেষ্টা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনেই অভিন্ন মত এসেছে যে নাট ঢিলা হওয়ার বিষয়টি মনুষ্য সৃষ্ট। এটা ইচ্ছাকৃত কি না তদন্ত কমিটির পক্ষে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
গতকাল রবিবার বিকালে সচিবালয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ উপলক্ষে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রেস ব্রিফিং করেন। এর আগে ২০০ পৃষ্ঠার তদন্ত এবং ৪৮ পৃষ্ঠার রিপোর্ট মন্ত্রীর কাছে জমা দেয় বিমান মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। অতিরিক্ত সচিব স্বপন কুমার সরকারের নেতৃত্বে এ তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মো. হানিফ ও ইঞ্জিনিয়ার নিরঞ্জন রায়।
এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পক্ষে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টও মন্ত্রীর কাছে ইতোমধ্যে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিমান পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানোসহ ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, ফ্লাইট অপারেশন, প্রকৌশল শাখা থেকে শুরু করে প্রতিটি শাখার ঊর্ধ্বতন থেকে নিম্নস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অদক্ষতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কঠোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বিমানের ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি)’ অনুসরণ করা হয়নি। বোয়িং কোম্পানির চেকলিস্টও উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বোয়িং ৭৭৭ ইআর ৩০০ এই উড়োজাহাজে দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে একটি ইঞ্জিনের ওয়েল ট্যাংকির নাট বোল্ট ঢিলা ছিল। ওই ইঞ্জিনের ওয়েল চুইয়ে পড়তে থাকার কারণে ওয়েলে চাপ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। ফলে ককপিটের মনিটরে ‘লো ওয়েল প্রেসার’ সংকেত দেয়। ওই সংকেত পাওয়ার পর চেকলিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনটি বন্ধ করে অন্যটি চালু করার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনটি চালু রেখেই পাইলট দূরবর্তী তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করান। তবে কোনো প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট পাইলটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার সুপারিশ নেই।
ঘটনার পর বিমানের প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে প্রথমে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার পাঁচ প্রকৌশলীসহ ছয়জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরা হলেন- প্রকৌশল কর্মকর্তা এস এম রোকনুজ্জামান, সামিউল হক, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, লুত্ফুর রহমান, জাকির হোসাইন ও টেকনিশিয়ান সিদ্দিকুর রহমান। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরো তিন প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন, বিমানের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (প্রডাকশন) দেবেশ চৌধুরী, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স) এস এ সিদ্দিক ও প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (সিস্টেম অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) বিল্লাল হোসেন।
উড়োজাহাজে যান্ত্রিক গোলযোগের ঘটনা তদন্তে গঠিত তিনটি কমিটির প্রতিবেদন সমন্বিত করে তা দুই-একদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অথবা তার কার্যালয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান বিমানমন্ত্রী। সেখানে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) বসেই সুনির্দিষ্ট করা হবে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, জানান মন্ত্রী।
গত ২৭ নভেম্বর বোয়িং ৭৭৭-ইআর ৩০০ উড়োজাহাজ ‘রাঙ্গা প্রভাতে’ করে প্রধানমন্ত্রী পানি শীর্ষ সম্মেলন- ২০১৬ এ যোগ দিতে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট যাচ্ছিলেন। সকাল ৯টা ১৪ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে এই ভিভিআইপি ফ্লাইটটি বুদাপেস্টের উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। প্রায় চার ঘণ্টা আকাশে উড়ার পর মধ্য আকাশে ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন এবিএম ইসমাইল মনিটরে বিমানের বাম দিকের ট্যাংকিতে তেলের পরিমাণে গরমিল দেখতে পান। এক পর্যায়ে তিনি নির্ধারিত গতিপথ পরিবর্তন করে আশগাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন।