নিউজ ডেস্ক:
সওগাত নাজবিন খান। সম্প্রতি তিনি নির্বাচিত হন জাতিসঙ্ঘের তরুণ নেতা। সারা বিশ্ব থেকে ১৭ জন তরুণ নেতা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। তাদেরই একজন আমাদের ময়মনসিংহের প্রতিভাময়ী নাজবিন খান। অন্য ১৬ জনের মতো তিনিও নিজ দেশে কাজ করে যাচ্ছেন জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনে।
গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে অংশ নেয়া সহজও ছিল না। যুবদূত হওয়ার স্বপ্ন ছিল সমগ্র পৃথিবীর ১৮ হাজারের বেশি তরুণের। অর্থাৎ জমা পড়ে উল্লিখিত পরিমাণ আবেদন। নানা যোগ্যতা বিচার-বিশ্লেষণে তাদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয় ১৭ জনকে। নাজবিনের অবশ্য দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল, জাতিসঙ্ঘের যুবদূত হিসেবে তাকে নির্বাচন করা হবে। গত জুন মাসে তিনি আবেদন করেন ইয়াং লিডার বা যুবনেতা হওয়ার। অবশ্য ওই সময়ে তিনি ছিলেন জার্মানিতে। স্বল্পমেয়াদি গবেষণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন ক্লিন অ্যানার্জি নিয়ে আচেন (আরডব্লিউটিএইচ) ইউনিভার্সিটিতে। মাস দুই পরে আগস্টে ই-মেইল পান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের যুবদূতবিষয়ক দফতর থেকে। তাতে জানানো হলো, আপনি (নাজবিন) নির্বাচিত হয়েছেন জাতিসঙ্ঘের তরুণ নেতা। নাজবিন বলেন, এমন শুভ সংবাদ পেয়ে আমি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। খুশি লাগছিল এ জন্য যে, আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করব।
যেদিন তিনি এমন সুখবর পান, সেদিন বাংলাদেশে ফিরছিলেন জার্মানি থেকে। মাঝপথে অবস্থান করেন আবুধাবিতে। বারবার ওপেন করছিলেন ই-মেইল ইনবক্স। কারণ তার যেন আর তর বা অপেক্ষা সইছিল না। সেখানে বসে তিনি জানতে পারেন এসংক্রান্ত সব পজিটিভ বিষয়। অর্থাৎ পাড়ি জমাতে হবে নিউ ইয়র্কের পথে। আর সেটি ১৭ সেপ্টেম্বর (২০১৬)। তিনি আরো জানতে পারেন, সাধারণ অধিবেশনে যুবদূতদের থাকতে হবে ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর (চার দিন)।
এত বড় বিশাল আয়োজনে অংশ নিতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু তার হাতে ছিল না পর্যাপ্ত সময়। তার পরও কৌশলে সেরে নেন এসংক্রান্ত নানা কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়ে যান নাজবিন। বেশ বেগও পেতে হয়েছে নির্বাচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। বলা যেতে পারে সব সম্পন্ন করতে হয়েছে মাত্র ৯ থেকে ১০ দিনে। এর মধ্যে আবার বেশ কয়েক দিন পড়ে যায় ঈদের ছুটি। সব মিলিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায়ও থাকতে হয় নাজবিনকে। তার পরও হাল ছাড়েননি। যোগাযোগ করেন মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে পাওয়া যায় এ সংক্রান্ত পূর্ণ আশ্বাস। হাতে পান ভিসাসহ পাসপোর্ট। তা পাওয়ার দিনই নিউ ইয়র্কের বিমানে ওঠেন রাতের ফ্লাইটে।
তিনি বলেন, আমাদের সবার নাম পড়ে শোনান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের যুবদূত আহমেদ আলহানডাউ। এ সময় দারুণ উত্তেজনা অনুভব করি। অনেকে বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের সম্মানজনক আমন্ত্রণের ইতিহাসে এমন আয়োজন এর আগে আর ঘটেনি। তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে যান অন্যদের সাথে গত ২০ সেপ্টেম্বর।
সেখানে উপস্থিত নানা দেশের সরকারপ্রধান, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ আরো উচ্চপদস্থ অতিথিদের সাথে তরুণ নেতৃত্ব, এসডিজি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। সব অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ফেসবুক লাইভসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে। অর্থাৎ সারা বিশ্বই দেখে তা।
নাজবিন বলেন, সেখানে আমাদের কর্মশালা ছিল কৌশলগত পরিকল্পনাসংক্রান্ত। পরে কাজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয় ইউএনএফপিএ অফিসে। ভবিষ্যতে আমাদের করণীয় কী সে বিষয়েও আলোচনা হয়। উচ্চপদস্থদের সাথে মতবিনিময়েরও সুযোগ হয় তার। নীতিনির্ধারকেরা জানতে চান তাদের (যুবদূতদের) কাজের ধরন সম্বন্ধেও। বাংলাদেশে সওগাত নাজবিন খান উন্নয়নমূলক যে কাজ করেন, তাও ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে জাতিসঙ্ঘে। নির্বাচকদের নজরও কাড়ে তার গঠনমূলক এ সংক্রান্ত নানা কাজ।
তার শিক্ষকতা করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে ঢাকায় বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তারই গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায়। ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল এর কাজ। এরই মধ্যে তাকে চলে যেতে হয় ভারতে। তখনো অনার্স কমপ্লিট হয়নি। বোঝা যায় তখন তার বয়স ছিল বড়জোর ২১-২২ বছর। দেশে না থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন নিয়ে ঠিকই ভাবতে থাকেন। দেশে ফিরেই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তবে এসব কাজে প্রয়োজন পড়ে প্রচুর অর্থের। এ জন্য তিনি অনেক ঘোরাঘুরিও করেন। তার আহ্বানে অনেকে এগিয়েও আসেন। এখন এ প্রতিষ্ঠানে উদ্যোগীর যেন অভাব নেই। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তার স্কুল থেকেই শুরু করা হবে এসডিজি বিষয়ে সবাইকে জানানোর কাজটি। নাজবিন বলেন, এই স্কুলের কাজটা অনেক গুরুত্ব পেয়েছে জাতিসঙ্ঘের যুবদূত হওয়ার ক্ষেত্রে। আরো গুরুত্ব পেয়েছে কমনওয়েলথ যুব পুরস্কার, জার্মানির গ্রিন লিডার পুরস্কার ইত্যাদিও। এসব ছাড়াও ২০১৫ সালে এসডিজি নিয়ে গবেষণা করেন জাপানে। এটিও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। লেখালেখিতেও পটু। তিনি বলেন, নিজেদের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়াই হবে আমাদের প্রধান কাজ। এতে তরুণদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে, যা বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ করে দেবে। এর ইতিবাচক ফল আসবে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে।
বাবার সরকারি চাকরি। তাই কয়েকটি বিদ্যালয়ে পড়তে হয় নাজবিনকে। মেধাবী বলে ভর্তির সময় এক ক্লাস ওপরে নাম লেখান। পড়েন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক হয়েছেন ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ বা আইইউবি থেকে। অতঃপর পড়াশোনা করেন পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বিষয়ে, ভারতে।
দরিদ্র মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রেও ব্যাপক অবদান রয়েছে তার। তাই জিতেছেন ‘কমনওয়েলথ ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডস ২০১৬’। এমন পুরস্কার মাত্র চারজন পেয়েছেন কমনওয়েলথভুক্ত ৫৩টি দেশের মধ্যে।