নিউজ ডেস্ক:
সাবওয়ে থেকে ৭৩ স্ট্রিটের দিকে মোড় নিতেই ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা। মুখভর্তি দাড়ি। হাতে অনেক ফ্লায়ার। রাস্তা দিয়ে যে-ই যাচ্ছে একটি করে হাতে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম একটি ফার্মাসির ফ্লায়ার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভালো আছি।’ এর পর নাম বললেন_ মঞ্জুরুল ইসলাম। জানালেন, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বাড়ি। তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে প্রতিবন্ধী। বাকি দু’জন ঢাকায় ছোটখাটো চাকরি করে। জায়গাজমি তেমন নেই। দেশে ৪০ বছরের মতো গতরে খেটেছেন। এখানে মেয়ে আর জামাইয়ের সঙ্গে থাকেন। বছরখানেক আগে আমেরিকায় এসেছেন।
এত ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্লায়ার বিতরণ করতে কষ্ট হয় না_ বললেন, ঠাণ্ডা বলে তো জীবন আর থেমে থাকবে না। কাজ না করলে তো টাকা পাব না। স্নো পড়ার কারণে তিন দিন কাজ করতে পারিনি। দৈনিক কত ডলার আয় করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘২০ ডলার। ৪ ঘণ্টা কাজ করি।’ এটা দিয়ে হয়? ‘কিছু করার নেই। বললেই তো আর তারা আওয়ার বাড়িয়ে দেবে না। চাইলেই একটা কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বয়সের কারণে এখন তো আর ভারী কাজ করতে পারব না। বলেন, চাকরি থাকলে দিয়েন।’ ঠিক আছে বলে প্রস্থান করলাম।
৭৩ স্ট্রিটেই দেখা মিলল আরেক বাংলাদেশির। একটা দোকানের বাইরের অংশে শাটারে ঝুলিয়ে তিনি নারীদের জামাকাপড় বিক্রি করেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তিনিও জবুথবু। সংগ্রামী জীবনের গল্প বলা শুরু করেন ফয়সাল। জানালেন, এক দশক আগে আমেরিকা এসেছেন। দেশে ভালোই ছিলেন। ঢাকায় ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সব বিক্রি করে আমেরিকায় পাড়ি জমালেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন দেখতে পাননি। নিউইয়র্কে এসে টানা আট বছর অড জব করার পর দু’বছর ধরে এ ব্যবসা দিয়েছেন। শুরুতে মোটামুটি ভালোই চলছিল। কয়েক মাস ধরে বেশ মন্দা। মাস শেষে যা আয় হয় তা দিয়ে বাসা ভাড়ার টাকা জোগাড় করা কষ্ট। জানি না, এভাবে কতদিন টেনে নিয়ে যাব! মাঝে মধ্যে নিজের ওপর বেশ রাগ হয়। ভাবি, আবার অড জবে ফিরব।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি অনেক রেস্টুরেন্ট গ্রোসারি থেকে কাজের অফার পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশি কর্মচারীদের ঠকায়। বলতে গেলে কেউই নিউইয়র্কে যে মিনিমাম ওয়েজ, সেটা দেয় না। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের বাস্তব অবস্থা বুঝতে ৭৩ স্ট্রিটের ৩৭ এভিনিউতে একটি বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে গেলাম। খাবারের অর্ডার দিলাম। অর্ডার নিলেন আশরাফ (ছদ্মনাম)। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানালেন, তিনি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিও করতেন। ১/১১-এর পর তিনি দেশ ছাড়েন অনেকটা পরিবারের চাপে। ভাগ্যান্বেষণে প্রথমে যান লন্ডনে। দু’বছর থাকার পর চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। এসেই কোনো উপায় না দেখে রেস্টুরেন্টের কাজে যোগ দেন। ঘণ্টায় ৫ ডলার দেয়। সঙ্গে কিছু টিপ্স পান। জানালেন, লিগ্যাল স্ট্যাটাস বজায় রাখতে একটা কলেজে কোনো রকম অ্যাডমিশন নেন। সপ্তাহে ছয় দিন ১০ ঘণ্টা কাজ করেন। দুপুর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। রয়েছে কাস্টমার ও মালিকের দুর্ব্যবহার। কাজে যতক্ষণ থাকি চুপচাপ থাকি।
কথা বলতে বলতে এক সময় তার চোখ অশ্রুসিক্ত। তাকিয়ে দেখি চোখ দুটি অনেকটা খোলসের ভেতর চলে গেছে। অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চাইলেও তা সংবরণ করার চেষ্টা করছেন। একটা হাত বের করে দেখালেন, একদিন সালাদ কাটতে গিয়ে আঙুলই কেটে ফেলেছিলেন। অনেক সেলাই দিতে হয়েছিল। ১৫ দিনের মতো কাজ করতে পারেননি। এভাবে কতদিন জানতে চাইলে আশরাফ বলেন, কখনও ভাবিনি_ জীবনে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। এখান থেকে সরতেও পারছি না। বাবার অনেক টাকা খরচ করে এখানে এসেছি। খালি হাতে ফিরে গেলে কী জবাব দেব?
শুধু আশরাফ, ফয়সাল আর মঞ্জুরুলই নন; নিউইয়র্কে ভাগ্য-বিড়ম্বনার শিকার এ রকম হাজারো মানুষ। উচ্চ জীবনের স্বপ্ন নিয়ে হাজারো বাংলাদেশি আমেরিকায় এলেও সে স্বপ্ন রঙিন হয়ে ধরা দেয় না অধিকাংশের জীবনে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী; গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ডেকোটা