নিউজ ডেস্ক:
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ‘জরুরি পরিস্থিতি’ অজুহাত দেখিয়ে ৮০০ কোটি টাকা বেশি দিয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
‘ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ (এমওটিএন) ’ নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিটিসিএল ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকার প্রস্তাব পেয়েছিল একটি চীনা কোম্পানির কাছ থেকে। কিন্তু সংস্থাটি ২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা দিয়ে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এটা করার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ ও সরকারি ক্রয় আইন লঙ্ঘনসহ নানা কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিটিসিএল সূত্র ও প্রকল্পের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে অনিয়মের এ চিত্র পাওয়া গেছে।
বিটিসিএল সূত্র জানায়, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এমওটিএন শীর্ষক প্রকল্পের যন্ত্রপাতির মূল্য ও পরিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে গত ডিসেম্বরে। আর সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চীনের একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে এ বছরের আগস্টে। প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দেবে—এমন শর্তের কথাও বলে দেওয়া হয় অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশে। এ নির্দেশনার পরও ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন না নিয়েই বেশি দর দেওয়া চীনা প্রতিষ্ঠান জেডটিইর সঙ্গে গত ২৭ সেপ্টেম্বর চুক্তি করেছে বিটিসিএল।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনা দরপত্রে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া নিয়ে আমি বেশ কয়েকবার প্রশ্ন তুলেছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আমাকে জানিয়েছেন, জেডটিইকে একমাত্র কোম্পানি হিসেবে মনোনীত করে চীনা দূতাবাস চিঠি দিয়েছে।’
কমিটি না করেই মূল্য নির্ধারণ: গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের বলা হয়, জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব অথবা অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এমওটিএন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কমিটি গঠন করেনি। এর পরিবর্তে শুধু বিটিসিএল, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এমন সব কর্মকর্তার সমন্বয়ে দর-কষাকষির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত: অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি এই প্রকল্পে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি ব্যবহারের নীতিগত অনুমোদন দিলেও কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কী দরে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনা হবে, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি। প্রকল্পটির বিষয়ে ওই কমিটির সভায় বলা হয়, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হবে সেটি বিবেচনা করবে ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ বা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
অতিরিক্ত ক্রয়মূল্য: প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, ৪৫০ বৈদ্যুতিক পাখা কেনা ও সেগুলো লাগানোর খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ডলার বা ৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে একটি পাখা কেনা ও লাগানোর খরচ পড়বে ১ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া ২ লাখ ৮০ হাজার সক্ষমতার ফাইবার টু দ্য হোম (এফটিটিএইচ) যন্ত্রের ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ৯৮ হাজার মার্কিন ডলার। বাজারে এই যন্ত্রটি জিপন নামে পরিচিত। প্রকল্পের জন্য যেসব জিপন কেনা হবে সেগুলোর মূল্য ১০১ ডলার দেখানো হলেও এগুলোর প্রকৃত মূল্য ৪৫ মার্কিন ডলার বা তার কম বলে জানিয়েছে একাধিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। অথচ এর আগে বিটিসিএলের দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা ১ লাখ ২৬ হাজার জিপনের সিংহভাগই অব্যবহৃত রয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্দেশনা উপেক্ষিত: ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পটির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে একই কাজ কম দর দেওয়া চীনেরই আরেক কোম্পানির প্রস্তাব বিবেচনা ও দর-কষাকষির মাধ্যমে ব্যয় কমানোর কথা বলা ছিল। তারপরেও বেশি দরের জেডটিইর সঙ্গেই বাণিজ্যিক চুক্তি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজ উদ্দিন আহমেদের কার্যালয়ে গিয়ে ও ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বিটিসিএলের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মীর মোহাম্মদ মোরশেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি এখন এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ অগ্রহণযোগ্য। অনেক আগেই বিটিসিএলকে লিমিটেড কোম্পানি করা হলেও বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠানটির নেই। এই প্রকল্পের ঋণের অর্থ শোধ করতে গিয়ে জনগণের ওপর বোঝা চাপানো হবে।