কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা হতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের নাম। এই দলের শীর্ষ ছয়টি পদে কারা আসছেন, তা অনেকটাই চূড়ান্ত হয়েছে। এছাড়া সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের একাংশের উদ্যোগে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতিও চলছে। দলটি গঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শামীম কামাল। এরই মধ্যে এই দলের সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই দুই সম্ভাব্য দলের বাইরেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের পাঁচই অগাস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় মাসে ১৬টি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। গত বছরই আত্মপ্রকাশ করে ১১টি দল। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে পাঁচটি দল আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে এসব দলের বেশির ভাগের লক্ষ্য অস্পষ্ট। কোনো কোনো দল এখনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি।
কোনো কোনো দল অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নতুন আত্মপ্রকাশ করা বেশির ভাগ দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, তাঁরা এখনো জানেন না দলের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। তবে মাঠে থাকার চেষ্টা করছেন। কয়েকটি নতুন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা বিভিন্ন থানা ও জেলায় আংশিক কিছু কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের পূর্ববর্তী কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এই দলগুলোর মধ্যে রয়েছে—ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, আমজনতার দল ও বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি।
ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামে একটি নতুন দল আত্মপ্রকাশ করে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। হাফেজ মাওলানা মাহমুদ আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাফেজ মাওলানা ইলিয়াস হোসাইনকে সদস্যসচিব করে দলটি ৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে। তবে ঘোষণার পাঁচ মাস পার হলেও দলটি এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে আহ্বায়ক মাহমুদ আব্বাস জানান, দলটি এখন সাংগঠনিকভাবে গোছানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ চলছে, তবে সামগ্রিকভাবে সংগঠনটি এখনো এলোমেলো অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জেলায় আংশিক কমিটি ঘোষণা করছি। ঈদের পর থেকেই পূর্ণাঙ্গভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করব।”
গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল সমতা পার্টির কার্যক্রম এখনো সংগঠনের প্রস্তুতির মধ্যেই রয়েছে। দলটির আহ্বায়ক হানিফ বাংলাদেশি জানান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হলেও এখনো সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করা সম্ভব হয়নি।
হানিফ বাংলাদেশি বলেন, “আমরা মানবিক সমাজের দাবিতে ‘মার্চ ফর হিউমেনিটি’ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক কমিটি গঠনের চেষ্টা করছি।”
গণ অধিকার পরিষদ ভেঙে আসা একাংশের সদস্যরা চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি ‘আমজনতার দল’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করেন। তবে দলটি এখন পর্যন্ত ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী কার্যক্রম ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেনি।
দলের সদস্যসচিব মো. তারেক রহমান জানান, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী লড়াই করে আসছি এবং এখনো এ বিষয়ে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এখনো নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করিনি।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে দল গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টির চেয়ারম্যান ইসমাইল সম্রাট। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ’ মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি আত্মপ্রকাশ করে।
ইসমাইল সম্রাট বলেন, “বাংলাদেশে একটি বড় ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল মাঠ থেকে সরে যাওয়ায় রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সেই শূন্যতা পূরণ করতেই আমাদের দল ঘোষণা করেছি।”
নতুন দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে কিছু ক্রিয়াশীল রয়েছে সার্বভৌমত্ব আন্দোলন ও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ। সার্বভৌমত্ব আন্দোলন গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে। দলটি প্রাথমিক পর্যায়ে সাতজনকে উপদেষ্টা করেছে। তাঁরা হলেন কর্নেল (অব.) মশিউজ্জামান, সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী, হেলাল উদ্দিন, ফজলুল সাত্তার, ড. মেজর (অব.) সিদ্দিক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তোফায়েল ও এআইজি (অব.) মালেক খসরু। এ ছাড়া ১০ জনকে সংগঠক ও ৮৩ জনকে সহসংগঠক করা হয়েছেG
আগামী নির্বাচনে ৫০ জনের বেশি প্রার্থী নিয়ে অংশগ্রহণ করবে ‘সার্বভৌমত্ব আন্দোলন’—এ তথ্য জানিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় সংগঠক শ্মশান ঠাকুর। তিনি বলেন, “আমাদের নির্বাচনী পরিকল্পনা রয়েছে এবং দুটি সেল ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য কাজ করছে। তবে আমরা কোন দলের সঙ্গে জোট গঠন করব, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”
এদিকে, দলটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন সার্বভৌমত্ব আন্দোলনের উপদেষ্টা সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী। তিনি জানান, “আমরা আত্মপ্রকাশ করার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সাধারণ মানুষের কিছু সমস্যা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি। এছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও বিডিআর সদস্যদের নিয়েও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমাদের পরিকল্পনা হলো, যদি আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়, তাহলে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ। দলটি মুসলিম জাতীয়তাবাদী নতুন ধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে আত্মপ্রকাশ করে। খোমেনী এহসানকে আহবায়ক ও হাসান আরিফকে সদস্যসচিব করে ৭৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে দলটি।
দলের কার্যক্রমের বিষয় জানতে চাইলে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সদস্যসচিব হাসান আরিফ বলেন, আমরা আমাদের ১১ দফা দাবি জানিয়েছিলাম। এই দাবিগুলো বাস্তবায়নে আমরা লিফলেট বিতরণ ও পথসভা করছি। এর পাশাপাশি আমরা ছাত্র-জনতার সব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছি।
‘নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি)’ ২৩ আগস্ট প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ১৮ দিন পর অনুষ্ঠিত হয়। দলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আত্মপ্রকাশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে দলটির আহ্বায়ক হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসাইন নিজের নাম ঘোষণা করেন। এছাড়া অপরাধ বিশেষজ্ঞ এসএসডি জিদানকে সদস্যসচিব এবং ইফতেখার আহমেদ খানকে দলের মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের ১৬ দিন পর ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে এস এম শাহাদাতের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি’। দলটি ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করে, যেখানে সাইফুল আলমকে মহাসচিব এবং মীর আমির হোসেন আমুকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
এছাড়া জানা গেছে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টির নেতাকর্মীরা জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটভুক্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) থেকে বের হয়ে এই নতুন দল গঠন করেছেন।
গত বছর পাঁচটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ:
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি)’, যা গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির আহ্বায়ক করা হয় মো. সিরাজুল ইসলামকে এবং যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মো. বকুল হোসেন হৃদয়।
১৫ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি)’, যার ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। লন্ডনপ্রবাসী মো. সোহেল রানাকে দলটির আহ্বায়ক করা হয়।
২৮ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করে, নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে। দলটি ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে এবং কণ্ঠভোটে প্রকৌশলী ইকরামুল খান চেয়ারম্যান ও আবুল কালাম আজাদ মহাসচিব নির্বাচিত হন।
৩০ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি)’। গোপালগঞ্জ জেলার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রশিদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
চলতি বছর আরো তিনটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ:
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে ‘দেশ জনতা পার্টি’। দলটি ১০৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে, যার কমিটি ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইকবাল কবির। মো. নূর হাকিমকে চেয়ারম্যান এবং ইদ্রিস আলী নান্টুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
২৮ জানুয়ারি মেজর জেনারেল (অব.) মো. এহতেশাম উল হকের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি’ নামে আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দল।
১৮ ফেব্রুয়ারি ‘নতুন সমাজ সমৃদ্ধ দেশ, হোক জনগণের বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’। দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার ঘোষণা দেন দলের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. বিভূতি রায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেG
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতার নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল:
২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী এলাকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দলটি ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে গোপনীয়ভাবে উন্মোচন করা হয়, যেখানে ছাত্রলীগের মতোই লোগো ব্যবহার করা হয়।
দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে আল রিয়াদ-আদনান অন্তর এবং মহাসচিব হিসেবে খলিলুল্লাহ গাজীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া হুমায়ুন কবিরকে দলটির মুখপাত্র হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।