|| মু. আবদুল হাকিম ||
বাংলা ভাষায় আমজনতাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য আদার ব্যাপারী বা মফিজ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করা হয়। অর্থাৎ বিগত ৫৩ বছরে জনগণের নাম করে জনগণকে রাজনীতি বা রাষ্ট্র থেকে কৌশলে মাইনাস করা হয়েছে। দেশ, জাতি ও সমাজ নিয়ে ভাবা আদার ব্যাপারীদের জন্য জন্ম থেকেই বারণ। না ভাবলে আদার ব্যাপারীর দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ এবং স্বজাতিবোধ আসবে কীভাবে? না ভাবলে দেশের জন্য ভালো নীতি সিদ্ধান্তগুলো আসবে কোথা থেকে? ৫৩ বছর ধরে প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় সমস্যাগুলোর সমাধান শেষ পর্যায়ে গিয়ে কোথায় আটকে যায়? কেন আটকে যায়? নেতা আর পীরের হাওলায় সব ছেড়ে দিলে দেশ চলবে ক্যামনে? আদার ব্যাপারী জানে না এবং তাকে জানতে দেয়া হয় না যে রাষ্ট্র নামক জাহাজটির প্রকৃত মালিক সে। ৫৩ বছর ধরে আদার ব্যাপারীদের জাহাজের কোনো খবর জানতে দেয়া হয় না। নীতি নির্ধারণে অংশ নেয়াতো অনেক দূরের কথা। জানতে চাইলে বলা হয় তুমি আদার ব্যাপারী তোমার জাহাজের খবর নেয়ার দরকার কি। বর্তমান প্রবন্ধটি আদার ব্যাপারী সংক্রান্ত একটি আম বয়ান মাত্র।
স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থের জাহাজ কোন বন্দর থেকে কোথায় যায় তার বিস্তারিত গতিবিধি আদার ব্যাপারীদের প্রতিনিয়ত জানতে হবে। ব্যাংক লোপাট, শেয়ার মার্কেট লোপাট, উন্নয়ন বাজেট লোপাট এবং অর্থনীতি সাবাড় করে দেয়া হয়। হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হ্যারিকেন অথচ আদার ব্যাপারীদের কাছে এসবের কোনো খবর নেই। কাজেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যে এসব অপকর্মের অফুরন্ত উৎস তা আদার ব্যাপারীদের মাথায় ঢুকে না। নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার, মনোনয়ন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেন্ডার বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ইত্যাদির অফুরন্ত উৎস যে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ তা আদার ব্যাপারীদের মাথায় কোনো দিন ঢুকে না। ব্যাংক এবং শেয়ার মার্কেটে আদার ব্যাপারীর কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। দেশে গণতন্ত্র নেই, সমাজতন্ত্র নেই অথচ আদার ব্যাপারীর হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেরাগ। মেগা চেতনা প্রকল্প দিয়ে ধোলাই করা হয়েছে আদার ব্যাপারীর আস্ত মগজ। চেতনার ট্যাবলেটে আদার ব্যাপারী বেহুঁশ। তার শরীরে কাপড় নেই। পেটে ভাত নেই। লোপাট রাষ্ট্রের কিছুই আদার ব্যাপারীর লেন্সে আসে না।
গুম, খুন, আয়নাঘর, গণহত্যা, টাকা পাচার ইত্যাদি কিছুই আদার ব্যাপারীর রাডারে আসে না। এই হ্যারিকেন বা চেরাগ দিয়ে পাকিস্তান এবং রাজাকার আলবদর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও মাইর খাবার ভয়ে কোনো দলের কর্মী তালিকায় আদার ব্যাপারীর নাম নেই। কেউ আন্দোলনে ডাকলেও আয়নাঘরের আজাব ও গুমের ভয়ে কোথাও যায় না আদার ব্যাপারী। আদার ব্যাপারীর মুখে তালা ঝুলে। মাথাটা বাতাসেও নড়ে না। অথচ আদার ব্যাপারীর দৈর্ঘ প্রস্থ বাড়ে না। দেশ-বিদেশে প্রচুর পড়াশোনা করলেও স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থের জাহাজগুলো আদার ব্যাপারীদের চোখে পড়ে না। এভাবে লোপাট হয়ে যায় বাংলাদেশ। আদার ব্যাপারীরা জাহাজের খবর নিজ গরজে জেনে নিতে চায় না। আবার গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমের কোনোটাই আদার ব্যাপারীদের নয়। অনেকগুলো পেপার পড়েও আদার ব্যাপারী দেশের কোনো আসল খবর পায় না। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই দৈনিক ঘাপলা, দৈনিক তুফান, দৈনিক তেলেসমাতি, দৈনিক চমক, দৈনিক হরিলুট, দৈনিক ধামাচাপা, দৈনিক তোলপাড়, দৈনিক তালকানা, দৈনিক চেতনা, দৈনিক গ্যাঞ্জাম ইত্যাদি।
গণমাধ্যমের খবরে আদার ব্যাপারী তালকানা। সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধু এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে প্রয়োগ করা যাবে। তাহলে প্রজাতন্ত্রের মালিক কে? এ বিষয়ে সংবিধান কবির মতো নীরব। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে যে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। অথচ এই আইনটি দেশে বলবৎ করার জন্য নেই কোনো সাংবিধানিক আদালত বা মানবাধিকার আদালত। তাহলে আদার ব্যাপারী অধিকার আদায়ের জন্য যাবে কোথায়? এমতাবস্থায় জনমনে এ প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক যে তাহলে সার্বভৌম কে জনগণ না সংবিধান। এই প্রশ্নের উত্তর দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রথম অনুচ্ছেদে দেয়া আছে এভাবে যে এই প্রজাতন্ত্রের নাম হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। অর্থাৎ এটি জনগণের তথা আদার ব্যাপারীদের প্রজাতন্ত্র। অন্য কারও নয়। তবে এই ক্ষমতা সংবিধানের আওতা বা কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কোনোভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। এই তবে, কিন্তু এবং যদি দিয়ে আদার ব্যাপারীকে আদার ব্যাপারী এবং বনসাই বানিয়ে রাখা হয়েছে। আদার ব্যাপারী তো আর সংবিধান বিশেষজ্ঞ নয়। কাজেই সাংবিধানিক আইনের মারপ্যাঁচ বুঝবার মতো ক্ষমতা তার নেই। বাহাত্তরের সংবিধানের ধাতুগত দুর্বলতা হলো তাতে প্রধানমন্ত্রী এবং বিচার বিভাগের কোনো জবাবদিহিতা নেই। রাজনীতির সাংবিধানিক ঈশ্বর প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারের সাংবিধানিক ঈশ্বর প্রধান বিচারপতি। এরা যখন সাংবিধানিক ঈশ্বর হিসেবে জনগণের বুকের ওপর গুলি চালাতে বলবে তখন সেনা প্রধান বা পুলিশ প্রধান কি তাদের কথা না শুনে নিজের বুকে এসএসএফের গুলি খাবে?
রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই। অথচ তারও জবাবদিহিতা আছে। সংসদ তাকে ইম্পিচ করতে পারে। অথচ সংসদ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের জন্য অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে তার পদ থেকে অপসারণ করতে পারে না। বুদ্ধিজীবীরা বলেন এটা করলে নাকি সরকারের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত করবেন? দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নৈতিকতা ও বৈধতা না থাকলে ডাকাত দল বা সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো পার্থক্য থাকে না। রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য অবশ্যই নীতি ও আইন লাগবে। প্রধানমন্ত্রীর কেউ সমালোচনা করলে তাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বেডরুম ছেড়ে আয়না ঘরে যেতে হবে না। আপনি আইনবিদ হলেও বিচারপতিদের রায়ের সমালোচনা করতে পারবেন না। সমালোচনা করলে আপনাকে আদালত অবমাননার দায়ে জেল খাটতে হবে। কেন আপনি বার বার আয়না ঘরে যাবেন? কেন আপনি বার বার জেল খাটবেন? কেন আপনি বার বার শহিদ হবেন? কেন আপনাকে বার বার রাস্তায় নামার জন্য ডাকা হবে? আপনি তো আদার ব্যাপারী? আপনি তো আর প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতি হবেন না। আপনি সচিব বা সেনাপ্রধান বা পুলিশ প্রধান হবেন না।
কেন আপনি বার বার রাস্তায় নামবেন এবং পুলিশের পিটন খাবেন? প্রায় দুইশ’ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য জীবন দিল। আপনি প্রধান বিচারপতি আপনার কলমের এক খোঁচায় রায় দিয়ে তা বাতিল করে একজন ব্যক্তিকে বিনা ভোটে ১০ বছর ক্ষমতায় রাখলেন। অথচ ভয়ে আপিল বিভাগ তাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারেনি। তিনি গোটা দেশকে ভয়ভীতি দেখালেন অথচ তাকে কারও ভয়ভীতি দেখানোর হিম্মত হয়নি। তাহলে এই ১০ বছরে ব্যাংক লোপাট, শেয়ার মার্কেট লোপাট, উন্নয়ন বাজেট লোপাট, গুম, খুন, গণহত্যা, ছাত্রহত্যা ইত্যাদির দায়িত্ব কে নেবে? সিভিল সোসাইটিকে আপনি বলছেন অনির্বাচিত? অথচ এই অনির্বাচিত সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন আপনি সুষ্ঠু করতে পারছেন না। আবার তাদের আপনি সরকারে এক মিনিট সহ্য করতে পারছেন না। বমি করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোই তো ৫২ বছর দেশ পরিচালনা করল। এত দিন দেশ চালিয়ে কেন তারা দেশ বা রাষ্ট্র সংস্কার করেনি। এর কোনো জবাব নেই। কে শুনবে আদার ব্যাপারীর বোবা কান্না। অফিস আদালতে ঝুলে যায় আদার ব্যাপারীর ভাগ্য। অফিস আদালতে ঘুরতে ফিরতে তার জিন্দেগি ফুরিয়ে যায়। হ্রস্ব ই এবং ঈ শিখতে তার দম শেষ। ক্লিনিকে ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে তার বাজেট ফুরিয়ে যায় এবং পকেট খালি হয়ে যায়। হাসপাতাল, থানা, অফিস বা আদালতের কোথাও সে ভালো ব্যবহার পায় না।
অপরাজনীতি বা নোংরা রাজনীতি বা নষ্ট রাজনীতিকে সিংহাসনে বসিয়ে আপনি দেশে ভালো কিছুই আশা করতে পারেন না। আর এটা নষ্ট হচ্ছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির জন্য। রাজনীতি থেকে এগুলো সরাতে না পারলে ভালো লোক কোনো দিন রাজনীতিতে ঢুকতে পারবে না। অপরাজনীতিকে যদি আপনি টিকিয়ে রাখতে চান তাহলে তার পাশাপাশি অপশাসন, অপবিচার, অপআইন, অপজ্ঞান এবং অপতথ্যের চক্রকেও আপনার মেনে নিতে হবে। আপনি অনেক বড় বুদ্ধিজীবী অথচ এই সহজ হিসাবটা কেন বুঝতে পারছেন না? নষ্ট রাজনীতি তার নিজের নষ্টামি কোনোদিন সংস্কার করবে না। কেননা এখান থেকে তার বহুৎ কামাই হয়। এই কামাই এর রাস্তা বন্ধ হলে বদ লোক আর কোনোদিন রাজনীতি করবে না। ফলে শূন্যস্থানটা পূরণ হবে আদার ব্যাপারীদের মতো ভালো লোক দিয়ে। এই চক্রের বাইরে অবস্থানরত সিভিল সোসাইটি ছাড়া আর কারও পক্ষে সংবিধান সংস্কার করে বদ রাজনীতি সংস্কার করা সম্ভব নয়। পরিবেশ এবং পরিস্থিতির চাপে ক্ষমতাসীন সরকার সেটা অনুমোদনে অসম্মত নাও হতে পারে।
লেখক ঃ অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব