|| মিয়া মোঃ নাফিস সাদিক ||
সুন্দরবনের সুন্দর কথাটি বলতে হলে সুন্দরবন ঘুরে আসা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বহু দর্শনীয় স্থান ঘুরলেও সুন্দরবন দেখার সুযোগ বা সৌভাগ্য সেভাবে কখনো হয়ে ওঠেনি। সেই আফসোস মেটাতে পেরেছি ডিপার্টমেন্টাল ট্যুরের মাধ্যমে। আমাদের ট্যুরের আয়োজক ছিলো ডিপার্টমেন্টের পঞ্চম বিভাগের শিক্ষাথীরা। বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ মোট ৭৩ জন ঘুরে এলাম রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাহারি গাছপালা, বন্য পশুপাখি ও জীবজন্তু ঘেরা গা-ছমছম করা সুন্দরবন।
সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৭ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার বাংলাদেশের অংশে আছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন।
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা ও বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রাণী। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়।
গহিন অরণ্যে ঘেরা সুন্দরবন ভ্রমণ ছিল খুবই রোমাঞ্চকর । ভ্রমণকাহিনী নিয়ে দারুণ একটি অ্যাডভেঞ্জার উপন্যাস লিখে ফেলা যাবে , সেখানে অল্প কথায় সুন্দরবন নিয়ে কিছু লেখা আমার কাছে কিছুটা কষ্টকর।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ভার্সিটির বাসে করে রওনা হই রাত ১১ টা ৩০ মিনিটে , গন্তব্য ঈশ্বরদী জংশন। আমাদের ট্রেন সিডিউল ছিল রাত ১২ টা ১০ মিনিটে । কিন্তু ঐদিন তিতুমীর কলেজের আন্দোলন এর কারণে ট্রেন আসলো ভোর ৬টা ২৭ মিনিটে । সারারাত কাটাতে হলো নির্ঘুম অবস্থায় স্টেশনে। আমরা খুলনা স্টেশনে পৌঁছেছিলাম সকাল ১০ টায়।
খুলনা ৪ নম্বর বিআইডব্লিউটিএ নদীবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল পূর্বনির্ধারিত এজেন্সির জাহাজ। জাহাজে উঠে যার যার অবস্থান বুঝে নিলাম। জাহাজে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। প্রতিদিনই প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত জাহাজের ডেকে বসে খোলা আকাশের নিচে গানবাজনা ও আড্ডায় মেতে থাকতো আমার কিছু ব্যাচমেট এবং সিনিয়র । ভোরে ঘুম ভাঙত বনের পাখির কলরবে। তখন মনে হচ্ছিল যে, আবার সেই ছেলেবেলাকে ফিরে পেয়েছি।
এজেন্সির ব্যবস্থাপনায় আমাদের টিমের সঙ্গে যুক্ত হয় তিনজন গাইড এবং একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বন্দুকধারী নিরাপত্তাকর্মী। তাদের দিকনির্দেশনা ও যাবতীয় সহযোগিতায় আমরা নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে সুন্দরবন পরিদর্শন করি। পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখার জন্য বন বিভাগের যাবতীয় ফরমালিটিজ আগেই সম্পন্ন করে রাখা হয়েছিল।
সুন্দরবন সম্পূর্ণটা ভ্রমণ করতে না পারলেও আমরা আন্ধারমানিক ,কটকা, জামতলি বিচ, হিরণ পয়েন্ট , দুবলারচর , টাইগার পয়েন্ট, করমজল যেতে পেরেছি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুহূর্ত ছিল যখন জাহাজ সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা করে, আমাদের সবার সে কী কৌতুহল! যেন কোনো এক অজানা রহস্যময় গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম সবাই।
সুন্দরবনের প্রথমদিনটি ছিল একটু অন্যরকম, আমাদের জাহাজ যাত্রা শুরু করতে করতে ১১ টা ৩০ মিনিট, কি যে বলবো ট্রেন বিলম্বের কারণে এই অবস্থা। সকালের নাস্তা করলাম ১২ টার দিকে। আমাদের গন্তব্য ছিলো আন্ধারমানিক, পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন প্রায় সন্ধ্যা। আন্ধারমানিক সুন্দরবনের নতুন একটি ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। আন্ধারমানিক গিয়ে নামতেই চোখে পড়ে হরিণের প্রজনন কেন্দ্র। সেখানেও চোখে পড়ে সুন্দরী গাছসহ নানান প্রজাতির গাছ। তারপর লম্বা একটি ফুট ট্রেইলের ওপর দিয়ে পাখির কলরব শুনতে শুনতে হেঁটে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম এবং সেখানে অবস্থিত ওয়াচ-টাওয়ারে উঠে চারিদিক টা দেখলাম। রাত হবার আগেই আমরা জাহাজে চলে আসলাম,এবার যাত্রা জামতলা সমুদ্র সৈকত এবং উদ্দেশ্য সূর্যদয় দেখা। রাতের খাবার সেরে অনেক রাত পযন্ত আড্ডা চললো। জাহাজ সারারাত চললো, এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি যা লিখে প্রকাশ করা যায়না।
দ্বিতীয় দিন খুব ভোর বলতে গেলে রাত চারটায় ঘুম থেকে উঠে সবাই চা বিস্কুট খেয়ে সবাই ট্রলারে করে রওনা হই। জামতলা নেমে তিন কিলোমিটার হেটে পৌছে যায় সমুদ্র সৈকতে। জামগাছের কারণে এই জায়গায় নামকরণ করা হয় জামতলা সমুদ্র সৈকত। সূর্যদয় দেখলাম, ফেরার পথে চিত্রা হরিণ, বানর, বন্য শূকর দেখলাম খুব কাছ থেকে। মনে হচ্ছিল এত কাছ থেকে যে সুন্দরবন কখনো দেখতে পাবো তা কোনোদিন ভাবতে পারি নি। এরপর জামতলার ওয়াচ-টাওয়ার গুলোতে উঠে চারিদিক টা দেখলাম, কি অপূর্ব দৃশ্য সেটা। এরপর আমরা জাহাজে পৌঁছে সকালের নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের পথে। প্রথমে কিছুদূর হাঁটতেই চোখে পড়ে ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে আশপাশে অনেকটুকু অঞ্চলই খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। সেখানে চিত্রা হরিণের একটা দল দেখলাম, বনের ভেতর দক্ষিণ দিকে হাঁটলেই পরপর তিনটি টাইগার টিলা খুঁজে পাওয়া যায়। ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে আসি জাহাজে। এবার গন্তব্য হিরণ-পয়েন্ট, আমরা জাহাজে এসে যে যার যার মতো নিজেদের কেবিনে চলে গেলো বিশ্রাম নিতে, আমিও তাই করলাম। আমাদের জাহাজ আবার চলতে শুরু করলো। প্রায় চার ঘন্টা পর আমরা হিরণ পয়েন্টে পৌছুলাম, জাহাজ থেকে লাইফ জ্যাকেট পরে নেমে আসলাম হিরণ-পয়েন্টে। হিরণ-পয়েন্ট দেখা শেষ করে আবার উঠে পড়লাম ট্রলার এ, এবার গন্তব্য দুবলার চর। এ যেনো এক নতুন এডভেঞ্চার, দুবলার চরে নামলাম প্রায় সন্ধায়, এখানে আমরা অনেক মজা করলাম, সাগরে খালি পায়ে হাটাহাটি করলাম এবং এখানকার স্থানীয় মানুষদের জীবন-বৈচিত্র দেখলাম। এদের একমাত্র জীবিকা মাছ ধরা এবং এখানে শুটকি পল্লি দেখলাম। সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি জায়গা। এখান থেকে আমরা সমুদ্র-স্নান করে আমরা জাহাজে ফিরে আসি।
ভ্রমণের শেষ দিন আমরা গেলাম করমজলে। করমজল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ সুন্দরবনের প্রবেশপথে ও মোংলা বন্দরের সবচেয়ে কাছে করমজল অবস্থিত। করমজলে নামতেই চোখে পড়বে ছোট-বড় নানা সাইজের বানর। মানুষের কাছ থেকে ব্যাগ-মোবাইল ছিনিয়ে নিতে পারলেই তাদের শান্তি মেলে। করমজলে ডলফিন, হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্রও চোখে পড়েছে। এ ছাড়া এখানে লবণাক্ত পানির কুমির, ডুবহাঁস, বানর, সাপ, শিয়াল, নদীর ডলফিন চোখে পড়ার মতো। পাখিপ্রেমীদের জন্য এটি চমৎকার একটি জায়গা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হওয়ার মতো।
সুন্দরবন এমন একটা জায়গা, যার সৌন্দর্য লিখে শেষ করা যাবে না। বর্তমানে সুন্দরবন অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়ছে যার বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট, যা খুবই দুঃখজনক। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ হারাতে পারে এই সৌন্দর্যকে, শেষ হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস হয়ে যেমন আমাদের রক্ষা করছে, তেমনি করে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সৃষ্ট হওয়া নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও আমাদেরকে আড়াল করছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন একটিই। এই বনকে রক্ষা করতে দ্রুত আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। সবার সুন্দর মনই পারে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে।
লেখক : মিয়া মোঃ নাফিস সাদিক, শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়