হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শওকত আলী সমকালকে বলেন, অতীতে মানসম্মত সেবা নিতে মানুষ যেভাবে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালমুখী হতেন, আগামীতেও সেভাবে হবেন। কারণ, সেরা মানে ফিরিয়ে নিতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি। গত এক বছরে বেশ কিছু উন্নয়ন করা হয়েছে। এতে হাসপাতালে রোগী সেবার পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। আধুনিক মানসম্পন্ন সেবার নিশ্চয়তার মাধ্যমে আবারও রোগীরা ঐতিহ্যবাহী এ হাসপাতালমুখী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
যেমন ছিল হাসপাতালটি: ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, শুরুতে এমন ছিল না হাসপাতালের চিত্র। ১৯৫৩ সালে সিস্টারস অব ফিলা ডিল ফিয়া নামে একটি মিশনারি প্রতিষ্ঠান এটি প্রতিষ্ঠা করে। স্বাধীনতার আগপর্যন্ত তারা হাসপাতালটি পরিচালনা করে। ওই সময় সিস্টার জন ফলি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ২০ বছর গৌরবের আসনে আসীন ছিল হাসপাতালটি। স্বাধীনতার পর ওই মিশনারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাছে হাসপাতালটি হস্তান্তর করে। তবে শর্ত ছিল, কোনো কারণে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি হাসপাতালটি পরিচালনা করতে না পারলে সিস্টারস অব ফিলা ডিল ফিয়ার কাছে হস্তান্তর করবে। কিন্তু হাসপাতালটি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিচালনা করে আসছে। ১৯৯০ সালের আগপর্যন্ত দেশের স্বাস্থ্যসেবায় গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছিল এ হাসপাতাল। তখন পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দ্যুতি ছড়াতেন। সেবার মানসিকতা নিয়েই তারা হাসপাতালটি পরিচালনা করতেন। অনন্য চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের একমাত্র অবলম্বন ছিল হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল।
অবনমন শুরু যেভাবে: হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দলীয় ব্যক্তিকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই ব্যক্তি নিজ এলাকার পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনকে প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন। পরবর্তী সব সরকারের সময় দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই সীমাহীন অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন। বিভিন্ন সময়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। অতিরিক্ত জনবলের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে হাসপাতালটি। ৫২৮ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৮৬২। এক বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল ৯২৬। কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অন্তত ৩০০ জনবল রয়েছে। গত এক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হাসপাতালে দিনে সর্বোচ্চ ৩০১ রোগী ভর্তি ছিলেন। গড়ে অর্ধেক শয্যা ফাঁকা থাকে। হাসপাতালের গড় আয় তিন কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে দুই কোটি টাকার বেশি খরচ হয় মাসিক বেতনের পেছনে। ফলে রোগীর পেছনে খরচ করার মতো পর্যাপ্ত টাকা থাকে না। এতে সেবার মান হ্রাস পেতে থাকে। মানসম্মত সেবা না পাওয়ার কারণে রোগীরাও হাসপাতালটির ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
হারানো গৌরবে ফিরছে: গত বছরের মার্চ মাসে হাফিজ আহমদ মজুমদারকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির চেহারা পাল্টাতে শুরু করে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি স্থগিত করেছেন; চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ সম্প্রসারণ করেননি। এ কারণে জনবল কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে তিনি সেবার গুণগত মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছেন। দীর্ঘদিনের পুরনো শয্যা ও যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করেছেন। ১০টি আন্তর্জাতিক মানের সেমি কেবিন তৈরি করেছেন। এসব কেবিনে ৩২ জন রোগী থাকার সুবিধা রয়েছে। তা ছাড়া হাসপাতালের সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সহায়তা চেয়ে কর্তৃপক্ষ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে চিঠি দিয়েছে। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এতে সাড়া দিয়েছে।
সহায়তার হাত বাড়ালেন যারা: রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নগদ অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেন_ পূবালী ব্যাংক পাঁচ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৬৬ লাখ, জিপি ইস্পাত অ্যান্ড ক্রাউন সিমেন্ট ৫০ লাখ, হা-মীম গ্রুপ ৫০ লাখ, শারমিন গ্রুপ ৫৫ লাখ টাকা; গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, পাকিজা গ্রুপ, নাসির চৌধুরী, মতিন চৌধুরী ও শহীদ খালেক-মেজর সালেক বীরউত্তম ট্রাস্ট ২৫ লাখ টাকা করে এবং মো. মাহবুব ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তা ছাড়া সাউথ-বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১০ লাখ ও রেশাদুর রহমান শাহীন নামের এক ব্যক্তি ১৪ লাখ টাকা দিয়েছেন।
এ ছাড়া ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা ফাউন্ডেশনের বহির্বিভাগসংলগ্ন পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করে দেবে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড। ওই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন হবে সাড়ে তিন হাজার বর্গফুট। হা-মীম গ্রুপ দুই কোটি টাকা ব্যয়ে বহির্বিভাগের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করবে। ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের নতুন এক্স-রে মেশিন ক্রয়সহ বিভাগের সংস্কার ও উন্নয়নকাজ করবে। এক্সিম ব্যাংক দোতলা ভবনবিশিষ্ট নতুন মসজিদ নির্মাণ করবে। বার্জার পেইন্টস, রোটারি এবং ঢাকা ক্লাব দেড়শ’ ড্রাম পেইন্ট প্রদানসহ হাসপাতালের বাইরের পেইন্টের কাজ করবে। একই সঙ্গে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার পাঁচ কোটি টাকা, এনভয় গ্রুপ জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালের সামনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ, ঢাকা ব্যাংক প্যাথলজি বিভাগের উন্নয়নে সহায়তা এবং রেশাদুর রহমান শাহীন শিশু ওয়ার্ডের সংস্কার ও আধুনিকায়নে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
জানতে চাইলে হাফিজ আহমদ মজুমদার সমকালকে বলেন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে তিনি কাজ করছেন। গুণগত সেবা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে রোগীদের হাসপাতালমুখী করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সমাজের বিত্তবান, দানশীল ব্যক্তিদের কাছে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিনি সহায়তা চেয়েছেন। অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে আধুনিক মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
হাফিজ আহমদ মজুমদার আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যে অবস্থায় হাসপাতালটি তিনি পেয়েছিলেন, তা রোগী সেবার উপযোগী ছিল না। প্রতিটি ওয়ার্ড, কেবিন ও টয়লেট অত্যন্ত অপরিষ্কার ও নোংরা ছিল। শয্যা, তোশক, বিছানার চাদর ময়লা ও পুরনো ছিল। প্রয়োজনের তুলনায় বাথরুম ও টয়লেট ছিল কম। অপরিচ্ছন্ন বাথরুমগুলো ব্যবহার করতে প্রসূতি ও জটিল অপারেশনের রোগীদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এসব সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। এখন আধুনিক ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ হাসপাতালের পরিবেশ উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে সাশ্রয়ী ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রোগী সেবার উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে বলে জানান তিনি।