ইলিশের আকাল ভরা মৌসুমেও

  • নীলকন্ঠ ডেস্ক: নীলকন্ঠ ডেস্ক:
  • আপডেট সময় : ০৭:৪৫:২১ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
  • ৭১৪ বার পড়া হয়েছে

ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল চলছে। বাজারে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। বৈশাখ থেকে আশ্বিন এই ছয় মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। কাগজ-কলমের হিসাব অনুযায়ী মৌসুমের অর্ধেক প্রায় গত, তবু উপকূলের নদী ও সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিলছে না। ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশায় বুক বেঁধে দিন-রাত উত্তাল সাগরে ভেসে থেকে দেনার বোঝা ভারী করে শূন্য হাতে ঘাটে ফিরছে জেলেদের ট্রলার। এখন খেয়ে না খেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো।

লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার ঢালচরের সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের প্রধান মাঝি খলিল উদ্দিন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, ভারত ও মিয়ানমারের পতাকাবাহী শতাধিক অত্যাধুনিক জাহাজ সব সময় সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে রয়েছে ২০-২৫টি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। ওইসব ট্রলার থেকে যান্ত্রিক উপায়ে এক ধরনের জাল ফেলা হয় সাগরে। এগুলো লাশা জাল নামে পরিচিত। তিন স্তরের ওই জাল ভেদ করে ছোট-বড় কোনো ইলিশই সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগরে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে। লোকসানের মুখে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ জেলেরা। এই কারণে বর্ষার ভরা মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলোতে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা মিলছে না। অল্প পরিমাণে মাছ বাজারে পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশচুম্বী। বর্তমানে ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ফলে কেজিপ্রতি দাম দাঁড়াচ্ছে ১,৭৫০ থেকে ২,৮০০ টাকা। এর মধ্যেও যদি দুই কেজি বা তার চেয়ে বড় ইলিশ পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি কেজিতে দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বরিশালের কাগাশুরা থেকে পোর্ট রোডে ইলিশ কিনতে এসেছেন রাজিব ঘোষ। তিনি বলেন, পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানের জন্য মান সাইজের কিছু ইলিশ নিতে এসেছিলাম। এসে দেখি গাড়ি ভাড়ার টাকাই গচ্ছা গেছে। তিনি বলেন, পোর্ট রোডে সাত-আট বছর আগেও আষাঢ় মাসে প্রতিদিন এক-দেড় হাজার মণ ইলিশ উঠতো। অথচ এখন দিনে ৩০/৪০ মণও আসে কিনা সন্দেহ। যা আসে তা নানান সিন্ডিকেটের কারণে এত বেশি দাম হয় যে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

এদিকে সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকায় বাংলাদেশের জলসীমায় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা তিন স্তরের বিশেষ ধরনের (লাশা-জাল) জাল ফেলছে। এভাবে উপকূলগামী ইলিশের গতি আটকে দিয়ে জেলেদের ভাগ্য ছিনিয়ে নিচ্ছে। জালে মাছ কম ধরা পড়ার প্রভাব পড়েছে বাজারেও। লক্ষ্মীপুরের রামগতি মেঘনা নদীর পারের আড়তগুলোতে দেখা গেছে, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়। ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকায়।

ইলিশ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময় খাদ্য সহায়তা না পাওয়ায় দুর্ভোগে আছেন জেলার জেলেরা। তবে গতকাল লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ১৫৮ জেলের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন অর্ধেক জেলে।

রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের কার্ডধারী জেলে আনিস ছৈয়াল বলেন, ‘সাগরে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় বরাদ্দের চাল আমরা প্রকৃত জেলেরা ঠিকমতো পাই না। আমাদের নামে চাল এলেও তা বিতরণের সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের লোকজনের মধ্যে ভাগ করে দেন। আমরা প্রতিবারই বঞ্চিত হই।

রায়পুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপুর ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিরাজ করছে। গভীর সাগরে সামান্য পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও নদ-নদীতে একেবারেই ইলিশের দেখা মিলছে না। পুরোদমে বৃষ্টিপাত হলে নদ-নদীতে ইলিশের সংকট কেটে যাবে।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলে সুজন আকন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা নেই তবে সাগর উত্তাল। সিগন্যাল থাকায় অনেক বোট মালিক সাগরে বোট পাঠায়নি। তাছাড়া, সাগরেও চাহিদামতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এক একটি বোট নিয়ে সাগরে যেতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকার মালামাল প্রয়োজন হয়। সেই টাকা উঠবে কি-না, তারতো নিশ্চয়তা নেই।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশের দাম ৬৮ থেকে ৭০ হাজার, ৮শ-৯শ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ টাকা, এক কেজির বেশি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ আট থেকে এক লাখ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি কচ্ছে। বড় আকারের ইলিশের দাম গত ১০ দিনের ব্যবধানে মণ প্রতি ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

ইলিশের আকাল ভরা মৌসুমেও

আপডেট সময় : ০৭:৪৫:২১ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫

ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল চলছে। বাজারে কিছু ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম আকাশচুম্বী। বৈশাখ থেকে আশ্বিন এই ছয় মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। কাগজ-কলমের হিসাব অনুযায়ী মৌসুমের অর্ধেক প্রায় গত, তবু উপকূলের নদী ও সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিলছে না। ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশায় বুক বেঁধে দিন-রাত উত্তাল সাগরে ভেসে থেকে দেনার বোঝা ভারী করে শূন্য হাতে ঘাটে ফিরছে জেলেদের ট্রলার। এখন খেয়ে না খেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো।

লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার ঢালচরের সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের প্রধান মাঝি খলিল উদ্দিন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, ভারত ও মিয়ানমারের পতাকাবাহী শতাধিক অত্যাধুনিক জাহাজ সব সময় সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে রয়েছে ২০-২৫টি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। ওইসব ট্রলার থেকে যান্ত্রিক উপায়ে এক ধরনের জাল ফেলা হয় সাগরে। এগুলো লাশা জাল নামে পরিচিত। তিন স্তরের ওই জাল ভেদ করে ছোট-বড় কোনো ইলিশই সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগরে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে। লোকসানের মুখে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ জেলেরা। এই কারণে বর্ষার ভরা মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলের বাজারগুলোতে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা মিলছে না। অল্প পরিমাণে মাছ বাজারে পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশচুম্বী। বর্তমানে ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ফলে কেজিপ্রতি দাম দাঁড়াচ্ছে ১,৭৫০ থেকে ২,৮০০ টাকা। এর মধ্যেও যদি দুই কেজি বা তার চেয়ে বড় ইলিশ পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি কেজিতে দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে।

বরিশালের কাগাশুরা থেকে পোর্ট রোডে ইলিশ কিনতে এসেছেন রাজিব ঘোষ। তিনি বলেন, পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানের জন্য মান সাইজের কিছু ইলিশ নিতে এসেছিলাম। এসে দেখি গাড়ি ভাড়ার টাকাই গচ্ছা গেছে। তিনি বলেন, পোর্ট রোডে সাত-আট বছর আগেও আষাঢ় মাসে প্রতিদিন এক-দেড় হাজার মণ ইলিশ উঠতো। অথচ এখন দিনে ৩০/৪০ মণও আসে কিনা সন্দেহ। যা আসে তা নানান সিন্ডিকেটের কারণে এত বেশি দাম হয় যে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

এদিকে সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকায় বাংলাদেশের জলসীমায় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা তিন স্তরের বিশেষ ধরনের (লাশা-জাল) জাল ফেলছে। এভাবে উপকূলগামী ইলিশের গতি আটকে দিয়ে জেলেদের ভাগ্য ছিনিয়ে নিচ্ছে। জালে মাছ কম ধরা পড়ার প্রভাব পড়েছে বাজারেও। লক্ষ্মীপুরের রামগতি মেঘনা নদীর পারের আড়তগুলোতে দেখা গেছে, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়। ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকায়।

ইলিশ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময় খাদ্য সহায়তা না পাওয়ায় দুর্ভোগে আছেন জেলার জেলেরা। তবে গতকাল লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ১৫৮ জেলের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন অর্ধেক জেলে।

রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের কার্ডধারী জেলে আনিস ছৈয়াল বলেন, ‘সাগরে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় বরাদ্দের চাল আমরা প্রকৃত জেলেরা ঠিকমতো পাই না। আমাদের নামে চাল এলেও তা বিতরণের সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের লোকজনের মধ্যে ভাগ করে দেন। আমরা প্রতিবারই বঞ্চিত হই।

রায়পুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপুর ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিরাজ করছে। গভীর সাগরে সামান্য পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও নদ-নদীতে একেবারেই ইলিশের দেখা মিলছে না। পুরোদমে বৃষ্টিপাত হলে নদ-নদীতে ইলিশের সংকট কেটে যাবে।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলে সুজন আকন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা নেই তবে সাগর উত্তাল। সিগন্যাল থাকায় অনেক বোট মালিক সাগরে বোট পাঠায়নি। তাছাড়া, সাগরেও চাহিদামতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এক একটি বোট নিয়ে সাগরে যেতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকার মালামাল প্রয়োজন হয়। সেই টাকা উঠবে কি-না, তারতো নিশ্চয়তা নেই।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশের দাম ৬৮ থেকে ৭০ হাজার, ৮শ-৯শ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ টাকা, এক কেজির বেশি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ আট থেকে এক লাখ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি কচ্ছে। বড় আকারের ইলিশের দাম গত ১০ দিনের ব্যবধানে মণ প্রতি ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।