বেরোবি প্রতিনিধি আজিজুর রহমান :
ভ্রমণ মানেই নতুন জায়গা, নতুন মানুষ আর অসংখ্য অজানা অভিজ্ঞতা। ভ্রমণ পিপাসুদের মাঝে ভ্রমনের এক প্রকার নেশা জমে। ভ্রমণ যেমন মনের প্রশান্তি জোগায় তেমনি চিন্তার জগতকে শানিত করে।
চেতনার জগৎ কে আর অজানা কে জানার প্রবল ইচ্ছে থেকেই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (বেরোবিসাস) সদস্যরা ঠিক করলাম আমাদের ভ্রমণের জায়গা ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত করতোয়া নদীর তীরঘেঁষা এক কালের বাংলার রাজধানী মহাস্থানগড়। যাহ পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত। বর্তমানে এ পুণ্ড্রনগর সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষিত।
কবির ভাষায়
থাকব না ক বদ্ধ ঘরে,
দেখবে এবার জগৎ টারে….
তাই ত কবির কবিতার লাইনের মতোই বলতে হয়
এবারে ভ্রমণে আমরা বেরোবিসাসের এগারো জন সদস্য ছিলাম৷ ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় বাকি সদস্যরা আমাদের সাথে মহাস্থানগড় ভ্রমণে সঙ্গী হতে পারেনি৷ আমাদের দিনলিপি শুরু কাকডাকা ভোরে। শুক্রবার সকাল সাতটায় রংপুর মডার্ন মোড় থেকে বাসে চড়ে আমাদের মহাস্থানগড়ের দিকে যাত্রা শুর। এর আগে সকলে একটু হালকা নাস্তা করে নেই।সকলের মধ্যে আনন্দানুভূতি কাজ করছিল কখন পৌছাবে একসময়ের প্রাচীন বাংলার রাজধানীতে। বাসের জানালা দিয়ে আমরা রাস্তার পাশে সবুজ বিস্তৃত মাঠ আর দালান ঘর গ্রাম শহরের মিশ্রন হৃদয় মোহিত করছিল আমাদের।বেলা সাড়ে আটটায় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা বাজারে আমাদের গাড়ী পৌঁছায় এবং সেখানেই নেমে পড়ি।
শাহ সুলতান বলখীর মাজারে আমরা:
প্রথমেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিখ্যাত সাধক শাহ সুলতান বলখীর মাজার দর্শনের মধ্যে দিয়ে আমাদের ভ্রমণ শুরু করব। শিবগঞ্জ বাজার থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে মাজারে গেলাম। মাজার যাওয়ার সময় চোখে পড়ল রাস্তার পাশে বিখ্যাত খাবার ডালডা ভাজা কটকটি দোকানগুলো। শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার ১৪শ শতাব্দীর মুসলিম ধর্ম প্রচারক তিনি পুণ্ড্রবর্ধন (বর্তমান বগুড়া জেলা) এবং সন্দ্বীপে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। তিনি পুণ্ড্রের রাজা পরশুরামকে পরাজিত করে পুন্ড্রবর্ধন জয় করেন।
গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘরে ছুটাছুটি :
দুইিট ভ্যান ভাড়া করে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে মাজারের পাশের বাজার দিয়ে সরাসরি রওনা করলাম গোকুল মেধের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখি দশটার আগে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই এ সময়ের মধ্যে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। গোকুল মেধ বেহুলার বাসরঘর নামে পরিচিত। বেহুলার বাসর ঘর বগুড়া সদর থানাধীন গোকুল গ্রামে অবস্থিত যা গোকুল মেধ নামে পরিচিত। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। প্রতœস্থলটি লোকগাঁথার নায়ক-নায়িকা বেহুলা-লক্ষ্মিন্দরের বাসর ঘর বলে জনসাধারণের কাছে পরিচিত।
কল্পনা করা হয় এটি শিব মন্দির ছিলো। বেহুলার বাসরঘরে ১৭২টি কুঠুরি বিভিন্ন তলে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। নিচ থেকে উপরের দিকে ক্রমহ্রাসমান করে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে সেটা দেখতে সুউচ্চ মন্দির বা স্তূপের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়। গোকুল মেধে সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা একসাথে ঘুরে ছবি তুলেছিলাম। বেরোবিসাস সদস্য সিদ্দিকুর রহমান এবং সাজ্জাদুর রহমান ডকুমেন্টারি করার জন্য ভিডিও করছিল৷
মহাস্থানগড় জাদুঘরে কিছুসময়:
বেহুলা বাসর ঘর দেখে হলে আমরা রওনা দিয়েছিলাম প্রাচীন বাংলার ও সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী মহাস্থানগড়। বাংলার অন্যতম একটি প্রসিদ্ধ পূরাকীর্তির স্থান। মহাস্থানগড়ের চারপাশের বিশাল দেয়াল যা প্রাচীন দুর্গগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। দুর্গের চারপাশে উঁচু প্রাচীর ও পরিখা নির্মিত হয়েছিল, যা শত্রুদের আক্রমণ থেকে শহরকে রক্ষা করত। প্রাচীরটি মাটি ও ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
মহাস্থানগড় প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘর মহাস্থানগড় এলাকা থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন- এর এক বিরাট সংগ্রহশালা। জাদুঘরের প্রবেশ পথে তিনটি প্রাচীন পাথুরে দরজা ও পিলার প্রদর্শনীতে রাখা ছিলো, যার পাশে অনেক দর্শনার্থীরাই দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। এছাড়া প্রবেশ পথের দুইপাশে আনুমানিক ১ম-১০ শতকের মধ্যে তৈরি বিভিন্ন পাদবেদি, ধ্যান বুদ্ধি এবং শিব লিঙ্গের মূর্তি নিদর্শন হিসাবে রাখা হয়েছে।
মূল জাদুঘরে অসংখ্য প্রাচীন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছিলো, তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়বে প্রদর্শনীতে থাকা অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি, ভাস্কর্য ও প্রতিমা। এদের মধ্যে অধিকাংশই তৈরি হয়েছিলো পাথর কেটে, আর সময়ের কালস্রোতে ও খননের সময় এদের মধ্যে কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কিছু কিছু ভাস্কর্য এমনও আছে যা একদম কোন আঁচড় ছাড়াই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এমন অনেক দেবতার ভাস্কর্য আমরা দেখেছি যাদের উপাসনা কালের পরিক্রমায় বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তারপরও হাজার হাজার বছর আগের এই নিখুঁত শিল্পকর্ম দেখে আমরা অবাক হতে বাধ্য হয়েছিলাম।
জাদুঘরে সংরক্ষিত নিখুঁত প্রাচীন শিল্পকর্ম যেমন আমাদের অবাক করেছিল৷ তেমনি আমরা বেশি অবাক হয়েছিলাম প্রাচীন বাংলার বর্ণমালায় লেখা একটি মন্দিরের বর্ণনা দেখে৷ সে সময়ের মুসলিমদের তৈরি ইট পাথুরে খুদায় সংবলিত আরবি হরফে লেখা মসজদি তৈরি বর্ণনা।
জাদুঘরে মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ছাড়া স্থান পেয়েছে কুমিল্লার ময়নামতি নওগাঁ শালবন বিহারে প্রাপ্ত পুরাকীর্তি ।
জিয়াৎ কূপ:
প্রতœতাত্ত্বিক জাদুঘরের পুরাকীর্তি নিদর্শন দেখা শেষ হলে আমরা যায় জিয়াৎ কূপ দেখতে। এর আগে আমরা জাদুঘরের পাশের একটা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করি।জনশ্রুতি আছে যে জিয়ৎ কূপের পানি পান করলে রাজা পরশুরামের মৃত সেনারা জীবিত ও আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত।
এই ঘটনার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় নি, কিন্তু এটাই আসলে মহাস্থানগড়ের অন্যতম সেরা একটি দিক। এই জায়গাটি যেমন আকর্ষনীয়, তেমনই রহস্যময়, যেখানে মিথ ও ইতিহাস এক সাথে ভ্রাতৃত্যের বন্ধনে আবদ্ধ।
জিয়াৎ কূপ দেখার পর দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা হালকা বিরতি দিয়ে রওনা দি বগুড়ার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আজিজুল হক কলেজ প্রদর্শন এবং ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দই খাওয়ার জন্য । কলেজ প্রদর্শন শেষে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা বগুড়া স্টেশনে যায় রংপুরে ফেরার জন্য৷ রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে আমরা রওনা দি রংপুরের উদ্দেশ্য।
ট্রেনে তার আপন গতিতে ছুটে চলছে দিগন্তজুড়া সবুজ গ্রাম আর মাঠ পেরিয়ে। গ্রামের মাঠগুলোতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ফুটবল খেলছে। যা গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে এবং আমাদের কে শৈশবের স্মৃতিকে স্মরণ করে দেয়৷
“ভ্রমণ শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রশান্তি দেয়। এই ভ্রমণ আমাদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর নিজের ভেতরের সাহস নতুন করে চিনিয়ে দিল। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যে এবং প্রাচীন শিল্পকর্ম পুরাকীর্তি সম্পর্ক জানতে সাহায্য করে। প্রতœতাত্ত্বিক স্থান ভ্রমণের মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন জনপদ তাদের শিল্পকর্ম সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারি৷
ভ্রমনের সার্বিক বিষয়ে বেরোবিসাসের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন,”মহাস্থানগড়ে আমাদের আজকের ভ্রমণ শুধু একটি শিক্ষা সফর নয়, বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় অন্বেষণের এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরীগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ঐতিহাসিক স্থানে এসে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো।
একজন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এই স্থাপনাগুলো শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এগুলো আমাদের অস্তিত্বের স্মারক, আমাদের ইতিহাসের প্রাণ। মহাস্থানগড়ের প্রতিটি ইট যেন শতাব্দীর সাক্ষী, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে অনুভব করেছি পুণ্যনগরের অতীত গৌরব।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে আমি আহ্বান জানাই, আমাদের সকল শিক্ষার্থী যেন অন্তত একবার এই মহামূল্যবান ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করে।
এতে করে আমরা শুধু আমাদের ইতিহাস জানবো না, বরং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও খুঁজে পাবো। আমাদের এই সফর সফলভাবে সম্পন্ন করতে যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ভবিষ্যতেও এমন জ্ঞানভিত্তিক ভ্রমণের উদ্যোগ আমরা চালিয়ে যাবো—এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।