মাছ চাষে যান্ত্রিকীকরণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিন বছরের গবেষণায় উঠে এসেছে সঠিক সময় ও পদ্ধতিতে এরেটর ব্যবহার করলে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় হেক্টরপ্রতি তেলাপিয়া উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণের বেশি পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে হ্যাচারি ও কিছু চিংড়ি ঘের ছাড়া এরেটরের ব্যবহার ছিল সীমিত। চাষিদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, বিদ্যুৎ ব্যয়, এবং কোন ধরনের এরেটর কোন সময় ব্যবহার করতে হবে এই বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি থাকায় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছিল না। এই বাস্তবতা থেকে অধ্যাপক মামুন পুকুরের জলের গুণগত অবস্থা, অক্সিজেন সরবরাহ ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করেন। তাঁর গবেষণায় প্রমাণিত হয় পুকুরের তলায় ডিফিউজার ডিস্কের মাধ্যমে বাবল সরবরাহ এবং ওপর থেকে প্যাডেল এরেটর চালালে পানির সব স্তরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন বজায় থাকে।
দুই ধরনের এরেটর সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে তিনি মাত্র পাঁচ মাসে হেক্টরপ্রতি ২০–২২ টন তেলাপিয়া উৎপাদনে সক্ষম হন। প্রচলিত পদ্ধতিতে যেখানে উৎপাদন ৭–৮ টনের বেশি নয়। গবেষণায় আরও দেখা যায় রাতে তুলনামূলক বেশি সময় এরেটর চালালেও সারারাত একটানা চালানোর প্রয়োজন হয় না। উৎপাদনের ধাপ অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিরতিতে এরেটর চালালেই পানি ৫ পিপিএম অক্সিজেন ধরে রাখে, ফলে বিদ্যুৎ খরচ কমে, কিন্তু উৎপাদন বাড়ে।
এরেটর ব্যবহারে পুকুরের তলায় অ্যামোনিয়া জমা কমে এবং নাইট্রিফিকেশন দ্রুত হয়। এতে প্রাকৃতিক খাদ্য বা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাবে ফিডের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আগে যেখানে ১ কেজি তেলাপিয়া উৎপাদনে ১.৫–২ কেজি ফিড প্রয়োজন হতো, সেখানে নতুন পদ্ধতিতে মাত্র ৬০০–৭০০ গ্রাম ফিডেই ১ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়।
পাঁচ মাসের একটি উৎপাদন চক্রে বিদ্যুৎ খরচ গড়ে ৭০ হাজার টাকার মতো হলেও ফিড সাশ্রয় হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। অতিরিক্ত মাছ বিক্রি করে আয় বৃদ্ধি পায় কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। ফলে আয়ের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়েই একটি হেক্টর পুকুরের জন্য প্রয়োজনীয় এরেটর স্থাপন করা যায়।
গবেষণার অংশ হিসেবে অধ্যাপক মামুন বর্তমানে সোলার সিস্টেম ও এইচডিপিই পণ্ড লাইনার ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব নিবিড় মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা যাচাই করছেন।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আমরা মাছ চাষের ক্ষেত্রে এরেটর সংযোজন করেছি।আমরা দেখেছি যে আমাদের উৎপাদন প্রায় দুই গুন বেড়েছে এবং খরচ অনেক কমিয়ে এসেছে।চাষি পর্যায়ে যদি আমরা এরেটর পৌঁছাতে করতে পারি তাহলে চাষিরা তাদের আয় রোজগার থেকে শুরু করে তাদের খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তায় এই ফার্মিং সিস্টেম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিনিধি ও টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. আবু তৈয়ব আবু আহমেদ বলেন, চাষিদের কাছে দ্রুত প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কিছু মডেল খামার স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
নোবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, এই গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ সাধারণ চাষিদের কাছে পৌঁছাতে পারলে দেশের মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি গবেষণার আর্থিক সহযোগী বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারকে ভবিষ্যতেও অনুরূপ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
“যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে নিবিড় মাছ উৎপাদনের একটি উন্নত মডেল প্রণয়ন” শীর্ষক এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রফেসর ড. দেবাশীষ সাহা, প্রফেসর ড. মো. রাকেব উল ইসলাম এবং রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট মিঠুন রায়।






















































