|| নাজনীন আক্তার বৃষ্টি ||
আমরা প্রতিদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। ভোরের আলো থেকে রাতের অন্ধকার—জীবনের ঘড়ি যেন অবিরাম ঘুরে চলে কাজের চক্রে। কখনো কি ভেবেছেন, আপনি এত পরিশ্রম কেন করছেন? কার জন্য করছেন এই নিরন্তর দৌড়ঝাঁপ? হয়তো পরিবারের সুখের জন্য, হয়তো সমাজের কল্যাণে, আবার কখনো ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণের তাগিদে আপনার প্রতিটি দিন ছুটে চলে। বাইরে থেকে এসব কাজ নিঃস্বার্থ মনে হলেও বাস্তবে কি আমরা সত্যিই নিঃস্বার্থভাবে কাজ করি, নাকি গভীরে লুকিয়ে থাকে আমাদের নিজেদের স্বার্থ ও সুখ খোজার প্রচেষ্টা ?
দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মানুষ মূলত নিজের সুখ, শান্তি ও তৃপ্তির জন্যই কাজ করে। এই আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবকে দার্শনিকরা Egoism নামে অভিহিত করেছেন। ‘Egoism’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Ego থেকে, যার অর্থ ‘আমি’। দার্শনিক Thomas Hobbes প্রথম এই ধারণা স্পষ্ট করেন। তার মতে, মানুষ যখন কোনো কাজ করে, তখন আসলে নিজের স্বার্থ, সুখ বা উপকারের জন্যই করে।
ধরুন, কেউ ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দিলে আমরা বলি এটি নিঃস্বার্থ কাজ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, সেই ব্যক্তি অন্যকে কষ্টে দেখে নিজের অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা করছে। ফলস্বরূপ, সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে সে নিজেই শান্তি পায়। আধুনিক গবেষণাও একই কথা প্রমাণ করেছে। ২০০৮ সালে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অন্যের জন্য খরচ করে, তারা বেশি সুখী থাকে। বিজ্ঞানীরা এই আনন্দকে Helper’s High নামে আখ্যায়িত করেছেন। যখন আমরা কাউকে সাহায্য করি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন, অক্সিটোসিন ও এন্ডরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
মনোবিশ্লেষণের জনক Sigmund Freud মানুষের আচরণ ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেন, মানুষ মূলত Pleasure Principle অনুযায়ী চলে—অর্থাৎ সে সবসময় আনন্দ খোঁজে এবং কষ্ট এড়িয়ে চলে। তিনি মানুষের মানসিক গঠনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন—Id, Ego, Superego। কোনো কাজ করার সময় এই তিনটি অংশ মিলেই আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কাউকে সাহায্য করি, কারণ Id আনন্দ খুঁজে নিতে চায়, Superego এটিকে নৈতিকতা বলে, আর Ego বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজটি করায়।
আমরা অনেক সময় দেখি, কোনো কাজ যদি আমাদের পছন্দমতো না হয়, আমরা আগ্রহ প্রকাশ করি না। এর কারণ হলো আমরা নিজেদের মানসিক শান্তি ও সুখ রক্ষা করতে চাই। মানুষ সবসময় নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। সামাজিক বিজ্ঞানী George Homans এই ধারণাকে Social Exchange Theory-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের সম্পর্ক ও আচরণ মূলত আদান-প্রদান বা give and take-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা অন্যকে সাহায্য করি, কারণ এর বিনিময়ে প্রত্যাশা করি সম্মান, কৃতজ্ঞতা, ভবিষ্যতের প্রতিদান, অথবা নিজের মনে শান্তি।
আধুনিক দার্শনিক Ayn Rand এই ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মতে, নিজের সুখ, স্বাধীনতা এবং স্বার্থ রক্ষা করা কোন দোষ নয়, বরং এটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এই ধারনাকে তিনি বলেছেন যুক্তিসংগত স্বার্থপরতা (Rational Self-Interest)। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী যদি নিজের স্বার্থকে অবহেলা করে সবকিছু বিলিয়ে দেন, তাহলে একদিন তার ব্যবসা থাকবে না এবং অন্যকে সাহায্য করার সামর্থও হারাবে।
এখন প্রশ্ন হলো—অন্যকে সাহায্য করা কি নিঃস্বার্থতা নাকি স্বার্থপরতা? বাস্তবে দুটিকে আলাদা করা কঠিন। অন্যকে সাহায্য করা মানে নিঃস্বার্থতার প্রমাণ নয়, বরং এটি আমাদের মানবিক স্বভাবের প্রতিফলন।স্বার্থপরতা ও নিঃস্বার্থতা একে অপরের পরিপূরক—‘আমি’ ও ‘আমরা’ মিলেই তৈরি করে প্রকৃত মানবিকতা।যখন নিজের স্বার্থকে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তখনই মানুষ তার আসল সত্তায় পৌঁছে যায়।
নাজনীন আক্তার বৃষ্টি
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়