নিউজ ডেস্ক:
ঘটনাটা যে এমন হবে কখনো ভাবিনি। আড়িখোলা রেলস্টেশনের তিন নম্বর লাইনে লোকাল ট্রেন ঈশা খাঁ ঢুকতেই মেজাজ বিগড়ে যায়। তার মানে এখানে নিশ্চয়ই দীর্ঘ বিরতি। হকাররাও বলতে লাগল, ‘কমচে কম তিনটা ট্রেন পাস দিবো।’ কথাটা শোনামাত্র নাকের নল দিয়ে এক দলা তপ্ত বাতাস বেরিয়ে যায়। বোধ হয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তা না হলে কেন লোকাল ট্রেনে উঠলাম। ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত আসতে চার ঘণ্টা খরচ। সামনে আরো চারটা স্টেশন বাকি। নরসিংদী যেতে হয়তো আরো ঘণ্টা দুয়েক খাবে। এ যন্ত্রণা যে মরণকেও…আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস নাক ঠেলে বেরিয়ে পড়ে।
চেয়ে দেখি, বগি খালি করে যাত্রীরা চা-পান-সিগারেটের দোকানের দিকে ছুটে যাচ্ছে। এতক্ষণ ভেতরে প্রচণ্ড গরম লাগছিল। এখন খালি হওয়াতে রোদ ছাঁকা ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। সামনের সিটে বৃদ্ধ লোকটি গা এলিয়ে বেদম ঘুমুচ্ছে। যতক্ষণ সজাগ ছিল এক মিনিটের জন্যও জিভকে ক্ষান্তি দেয়নি। কলের যন্ত্রের মতো বিরতিহীন কথা বলছিল তো বলছিলই। বৃদ্ধদের যা হয়। জীবনকাহিনী যেন সারাক্ষণ পেটের ভেতর বলি খেলার মতো ঘুরাপক খায়। কোথাও সুযোগ পেলে উগরে দিতে পারলেই বাঁচে। একবার শেষ হলো তো আবার শুরু করে। আমার দাদা ছিল…আমার বাপের ছিল…তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না, আমাদের আমলে কী ছিল আর কী দেখেছি…ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে শুনতে বিরক্তিতে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও ছাড়ে না।
এই লোকটাও যতক্ষণ সজাগ ছিল জ্বালিয়ে মেরেছে। তবে বলার স্টাইলটা চমৎকার। প্রথম বাক্য থেকেই চালান দেয়া বাটির মতো টেনে ধরে। যখন বলতেছিল ‘আমার বাজানের আছিল অনেক জমিজমা, সবই শেষ করলাম সাহেব-বিবির পিছনে।’ তখন যে-কেউ বাকিটুকু শোনার জন্য মনোযোগী হবে। আমিও তার দিকে তাকালাম। লোকটি তখন একটুু দম নিয়ে আবার বলতে লাগল ‘জুয়ার নেশা হইলো গিয়া জোঁকের মতন। যারে একবার কামড় দিয়া ধরে তারে চুইষ্যা না শেষ করা পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি নাই। হের হাত থিকা ছুটানের লাগি বাজান কত কিছু যে করল, পুলিশের ভয় দেহাইলো। কইলো, হাজতে ঢুকাইয়া রাখবো হারা জীবন। শুইনা হাসি পাইলো। পুলিশ হইলো জুয়াড়িদের বন্ধু। জুয়াড়িরা টেহা না দিলে হেগোর পেটে ভাত জোটেনি?’
একসময় ভিড় ঠেলে ‘পান-বিড়ি-সিগারেট, পান-বিড়ি-সিগারেট’ করতে করতে পেছন থেকে একজন ফেরিওলা এলে লোকটা তখন দুই টাকা দিয়ে একটা পাইলট সিগারেট কিনে এবং তাতে আগুন জ্বালিয়ে টানতে থাকে। প্রথম টানেই কাশির ঠেলা। তারপর নিজেকে কোনোমতে সামলে আবার শুরু করে, ‘শেষে পথ না পাইয়া অল্প বয়সে বিয়া করাইলো। সুন্দর মাইয়া দেইখা পোলা নি ঘর লয়, এই তার আশা। কিছুই অইলো না। সাহেব-বিবির চেহারা বউয়ের চে সুন্দর লাগে। সাহেব-বিবির মুখ সারাক্ষণ চোখের ছানি হইয়া ভাইসা থাহে। বৌয়েও চেষ্টা কম করে নাই। বুক-পিঠ উদাম কইরা কয়েক দিন কী-ই না তেলেসমাতি দেহাইলো। খালি দেইখাই গেলাম। গ্রহণ করলাম না। শেষে একদিন চইলা গেল। আর আইলো না। বাজান গেছিল আনতে, আয়ে নাই। বলে কি না- জুয়াড়ির ঘর করার চে মরণ ভালা। পরে আরেকটা করলাম। সেইটা বাজানের মরণের পর।’ আবার একটু দম নিয়ে শুরু করে, ‘জানেন…।’
কিন্তু আমি আর শুনি না। তবে শোনার ভান করে কেবল তার দিকে চেয়েই থাকি। মগজে ঢুকাই না। এমনিতেই মাথা গরম হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা করার প্রয়োজন। জানালার বাইরে বাতাসের স্রোতে মাথাটাকে ধরতে পারলে ভালো হতো। সেটাও সম্ভব নয়। জানালার শিক ধরে যেভাবে মানুষ ঝুলে রয়েছে তাদের শরীর ভেদ করে কিছুতেই বাতাস এদিকে আসবে না। তারপরও চেষ্টা করে একবার দেখা যেতে পারে ভেবে মাত্র হাতটা বাইরে বের করছি, ঠিক তখনই লোকটি আমার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ঊরুতে হাতে ঠেলা মারে। পুনরায় বসে পড়ি এবং তার দিকে তাকাই। এ ফাঁকে ছন্দ বদল হয়ে গেছে। দেখি তার বাক্যগুলো স্বরবৃত্তের সুইমিংপুল অতিক্রম করে মাত্রাবৃত্তের অতলে পড়ে আহত গজার মাছের মতো ভাসছে আর ডুবছে। ‘আইজকের এই সিদ্দতের জন্য কপাল রে দোষ দিয়া কাম নাই। সব দোষ আমার। বাজান মারা যাওয়ার সময় অনেক জমিজমা রাইখ্যা গেছিল। খালি হাতখান লাগালেই আমিও সাহেব-বিবিগোর মতন চলতে পারতাম, কিন্তুক ধরলাম না। জুয়া আমারে ধরতে দিলো না।’
শেষের কথাগুলো বেশ অস্পষ্ট হয়ে আসে। ঘাড়ের ওপর উপচে পড়া ভিড়। ঘামের দুর্গন্ধ। ভ্যাপসা গরম। সে সঙ্গে চেঁচামেচি-শোরগোল। বিরক্তিতে একবার ইচ্ছে হলো নেমে বাসে চলে যাই। টাকার চিন্তা করে বসে থাকি। এ অবস্থায় একজন সাধারণ মানুষের আত্মজীবনী শোনা ভালো লাগার কথা নয়। তার পরও তার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। অনুশোচনায় মুখের চামড়া যেন দু’পাশে দেবে গেছে।
‘গেছিলেন কোথায় ?’ জানতে চাইলাম।
‘গেছিলাম ঢাহা। ছেলের কাছে, কোরবানির টেহা আনবার লাইগ্যা। হে জুতার ফ্যাক্টরিতে কাম করে। কামের উপর পয়সা। হে হইলো আপারম্যান। দিনে এক ডজন মাল সাপ্লাই করতে পারে। আগে দুই ডজন পারত। এহন নতুন নতুন ডিজাইন হওয়াতে কাম আগায় না। তবে উপার্জন আগের মতোই। প্রতি ডজনে ছয়শো টেহা। খাইয়া-দাইয়া চাইরশোর মতন থাহে। তাও আবার সব দিন কাম থাহে না। সব মিলাইয়া মাসে ছয়-সাত হাজার বাড়িত পাঠাইতে পারে। বিয়েশাদি এহনো করাই নাই। আরেকটু সেয়ান ওক। তারপর দেহুম নে।’ আরো অনেক কথা শুনতে শুনতে মাথা গরম হয়ে যায়। কখন যে থেমে গেলেন টেরই পাই নি। যাবেন কুলিয়ার চর। স্টেশনের পাশেই নাকি উনার বাড়ি।
মিনিট দশেক পর একটা ট্রেন পেছন থেকে ছুটে গেল। যাত্রীদের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর হয়নি। মাত্র তো একটা গেল, সামনে আরো দুটো রয়েছে। এ সময় হাতে পত্রিকা থাকলে হতো। যদিও পত্রিকায় ‘রাজনীতির ইন্দুর-বিলাই খেলা’ ছাড়া পড়ার মতো আর কিছু থাকে না তার পরও হাতে থাকলে কোনো রকমে সময় পার করা যেত। যেহেতু নেই কী আর করা, হাতের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আমিও নেমে পড়ি। বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। এক কাপ চা খেলে রিল্যাক্স লাগবে। এ সময় সামনে থেকে আরেকটা ট্রেন ছুটে গেল। যাত্রীরা একটু নড়ে উঠল, আমিও পুনরায় সিটের দিকে ধাবিত হই এবং বসে সিগন্যালের দিকে তাকাই, দেখি লাল বাতিই। তার মানে আরো লেট হবে। মানুষ যে কেন আত্মহত্যা করে এবার বুঝেছি। এমন মরণদশায় পড়লে কার এত বাঁচার সাধ জাগে! আসলে মরার দেশে জন্ম নেয়াই পাপ। মনে মনে আরো কী যেন বলতে চাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই শেষ ট্রেনটা তীরের বেগে পেছনের দিকে ছুটে গল।
শুরু হলো হুলস্থুল। সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে দেখি সবুজ বাতি জ্বলছে। এখনই ছেড়ে দেবে। এ জন্যই সবাই তাড়াহুড়া করছে। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে ভিড়টা সামান্য বেশি। হয় তো শেষ বগি বলে। দৌড়াদৌড়ি করে কোনোমতে উঠে পড়ছে। আবার হাবিয়া দোজখ। হকার আর ভিক্ষুকের চিৎকার-চেঁচামেচিতে একসার। কাকতালীয়ভাবে এ সময়ই ঘটনাটা ঘটে। ‘খেলাটা একদম সোজা। এই দেখুন আমার হাতে মাত্র তিনটা তাস। দুটো কালো একটি লাল। লালটায় যত ধরবেন ডাবল পাবেন।’ বলেই চিকন-চাকন একটা লোক ধপ করে আমার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়ল। দেখতে নেশাখোরের মতো। চোখ দুটো কবুতরের রক্তের মতো লাল। জামা-কাপড়েও কোনো শ্রী নেই। চেহারা-সুরতে মনে হচ্ছে কয়েক দিন ধরে গোসলও করে না। সব কিছুতেই কেমন একটা রুক্ষ ভাব। হাতের তিনটি তাস গুঁইসাপের জিভের মতো দ্রুত এই তুলছে এই ফেলছে। পিঠ দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটি লাল। আমি বেশ মজা পাচ্ছি। ভিড়ের ভেতর কয়েকজন লোকও তার প্রতি মনোযোগী হলো। এরই মধ্যে দু-তিনজন দান ধরল। কেউ পেল, কেউ হারল। যে এক শ’ টাকা ধরল জেতার পর সে পেল দুই শ’ টাকা। আমিও কয়েকবার পকেটে হাত ঢুকিয়েছি। টাকা কম বলে লজ্জায় বের করিনি। বেকার, পকেটে টাকা আসবে কোত্থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সাত বছর হলো কর্মহীন। কয়েক জায়গায় টাকা দিয়েও কাজ হয়নি। বেশি পেলে আমারটা হবে কেন। বরং অন্ধকার হাতড়ে যে অর্ধেকটা ফেরত পেয়েছি, তাতেই হাজার শোকর। অনেকে আবার জ্ঞান দেয়, চাকরির পাছে এত দৌড়াই কেন, ব্যবসায় করলেই তো পারি। ব্যবসায়ই যদি করতে হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়া কেন এবার বেশ কয়েকজন পেয়েছে।
মনে হলো লোকটি এখনো ঠিকমতো পেকে ওঠেনি। যার ফলে হেরে যাচ্ছে। যে লোকটি জিতছে, তাকেও আমাদের মতো সাধারণ মনে হলো না। হয় তো হকার-টকার হবে। আজ পাচ্ছে কাল হারবে। গরিবেরা এভাবেই মরে। খুব মজা করে দেখছি। লোকটা টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে মুহূর্ত সময় একটু আনমনা হয়ে পড়ে। এ সময় আমার পাশে যে নতুন লোকটি বসেছে সে লাল পাতাটির সামান্য কোনা ভেঙে দেয়। বিষয়টা আরো দু তিনজনের চোখে পড়ে। এবার তাস ফেলতে না ফেলতেই চার-পাঁচজন এক শ’ করে কোনা ভাঙাটিতে ধরল এবং পেল। লোকটি বুঝতেই পারল না। এবার ফেলতে একটু সময় নিলো। হাতের তাসগুলো বিদ্যুৎগতিতে এলোমেলো করল। দেখে আমার চোখে ধাঁধা লাগে। তারপর খুব আস্তে করে তাস ফেলল কোনা ভাঙা তাসটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশের লোকটি তার সাথে তর্ক জুড়ে দেয়-
অ মিয়া তোমার কাছে কত আছে?
সেও সেয়ানা কম নয়। বলে আপনার যা খুশি ধরেন। দিতে না পারলে পাঁচ শ’ জুতার বাড়ি লমু।
বুঝলাম সাহস আছে।
লোকটি তখন কোনা ভাঙাটায় পাঁচ শ’ টাকা ধরে। তার দেখাদেখি আরো কয়েকজন। ‘এই ধরলাম আমি’ বলে বৃদ্ধ লোকটি লুঙ্গির কোচর থেকে চট করে পলিথিন কাগজে মোড়ানো ছোট একখানা পুঁটলিও ফেলল। বৃদ্ধ লোকটিও যে কখন সজাগ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো লক্ষ করছে আমি খেয়ালই করিনি।
আরো কেউ ফেলবেন? আরো কেউ ফেলবেন? কয়েকবার সে হাঁকালো। কেউ শব্দ করেনি। আমার দৃষ্টি তখনো তাসের পিঠে লাল পিঁপড়ার মতো হামাগুড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো সব ক’টারই যেন কোনা ভাঙা। এটা কিভাবে সম্ভব! চোখে ভুল দেখছি না তো! আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ ঠিকই তো, তিনটি তাসেরই কোনা ভাঙা যে, এটা কখন ঘটল? আমি বৃদ্ধ লোকটিকে সতর্ক করতে যাবো এসময় সে সব টাকা পকেটে ভরে নিলো। এবং তাস উল্টাল কেউ পেল না। বৃদ্ধ লোকটি কেবল একটি চিৎকারই দিলো ‘বাবা গো’। আর কিছু বলার সুযোগ পেল না, জ্ঞান হারালো। সবাই তার দিকে ঝুঁকে এলো। আমিও তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পাশের লোকটির কাছে পানির বোতল দেখেছিলাম। পানি ছিটিয়ে দিলেই স্বাভাবিক হবে এ মনে করে তার দিকে হাত বাড়ালাম। দেখি সে নেই। অন্য লোক বসা। জিজ্ঞেস করলাম তিনি কোথায়?
লোকাল ট্রেন তো, শালারা চলতি ট্রেনেই কেটে পড়েছে।