‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে জাতির পিতা হিসেবে সমাদৃত ও পূজণীয় হতে পারেন; কিন্তু বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে তিনি সমানভাবে শ্রদ্ধেয় ও জাতির পিতা নন। ইতিহাসে শেখ মুজিব একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক এবং তৎকালীন জাসদের প্রধান কমরেড সিরাজ শিকদারসহ ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রায় ৩০ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যার নির্দেশদাতাসহ বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, ভিন্নমতের অবাধচর্চা ও বাকস্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যার দায়ে অনেকের কাছে অভিযুক্ত ও ঘৃণিত।
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে হিসেবে (linkedin.com/in/karim-3b7ba1120/)- আমি এগারোটি প্রণিধানযোগ্য উপাদান উল্লেখ করছি- যেসব কারণে শেখ মুজিব বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কাছে জাতির পিতা হিসেবে সর্বজন নন্দিন ও গ্রাহ্য ব্যক্তিত্ব নন-
১. জনগণের সাংবিধানিক অধিকার তথা বাকস্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া: সংবাপত্র একটি জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি বা ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু পুরো রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবের সরকার ১৯৭৫ সালে মাত্র চারটি সংবাদপত্র বাদে দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ ধরনের নজির শুধু কর্তৃত্বপরায়ণ ও একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করা যায়। গণমানুষ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার প্রচেষ্টা কোনো জাতির পিতা করেছেনে বলে- এই মর্মে ইতিহাসে উদাহরণ বিরল।
২. শেখ হাসিনার ক্রসফায়ারের হত্যা নাটকের আবিষ্কারক শেখ মুজিব: ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত জাসদের ৩০ হাজার কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এবিষয়ে ওয়েবসাইটে বহু লেখনি পাওয়া যাবে। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি রাতে ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’র প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার তৎকালীন মুজিব সরকারের রক্ষীবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে আলোচিত প্রথম ক্রসফায়ারের সাজানো নাটক।
১৯৭৫ সালে ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন। এদিন রাতেই ওনাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের নামে সিরাজ সিকদারকে একটি পুলিশ ভ্যানে করে ২ জানুয়ারি রাতে ঢাকার অদূরে সাভারের তালবাগ এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ভ্যানে থাকা অবস্থায় কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হলেও- পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়- ভ্যান থেকে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টার সময় পুলিশের গুলিবর্ষণে সিরাজ সিকদার ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা একই কায়দায় ২০০৯ থেকে গত ৫ আগস্ট (২০২৪) লক্ষ-লক্ষ ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে পুরো শাসনামলে পিতার পথ অনুসরণ করে কয়েক হাজার মানুষ হত্যা ও গুম করেছেন কিংবা নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
৩. বহুদলীয় গণতন্ত্র গলাটিপে হত্যা: শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্তি ঘোষণা করে- রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করেন। এই শাসন ব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত। বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে ভারতের একটি প্রদেশের মর্যাদায় আমৃত্য ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। মুজিবের শাসনামলে বিরোধী কাউকেই কোনো রাজনৈতিক স্পেস দেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপি করতে হেলিকপ্টার পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। এভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ও ভোটব্যবস্থাকে কার্যত কালিমালিপ্ত করে গেছেন।
৪. সেনাবাহিনীকে অবমূল্যায়ন ও নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা: সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভারতে পরামর্শে রক্ষীবাহিনী নামে একটি আলাদা বাহিনী গঠন করে দেশের মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সার্বিক নির্দেশনা ও পরামর্শে গঠিত রক্ষীবাহিনীকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর থেকেও বেশি মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হয়। এ কারণে সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিলো, যেটার রেশ বা প্রভাব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা পর্যন্ত বর্তায় বলে অনেকের অভিমত।
৫. ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে অবিরাম দরকষাকষি: ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আত্মসমর্পনের আগপর্যন্ত শেখ মুজিব তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের অবিংসবাদিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি চালিয়ে যান। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা করতে চাইলে- শেখ মুজিব ভুটোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দরকষাকষি করতেন না।
৬. স্বাধীনতার ঘোষণার কোনো প্রমাণ রাখতে তীব্র অনীহা: পাকিস্তানি সেনাদের হাতে স্বপরিবারে আত্মসমর্পনের আগে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা জন্য কোনো ঘোষণাপত্র লিখে কিংবা রেডিও বার্তা রেকর্ড করে যান নি।
৭. উল্লেখ্য, প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২৪ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমেদ, সিরাজুল আলম খানসহ কয়েকজন গিয়ে বলেছিলো- আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে যান। মুজিবকে ওনারা বলেন- পুরান ঢাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, ওই বাড়িতে আত্মগোপনে থেকে ওনারা যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। তাই আপনি নিজে থেকে এরেস্ট হইয়েন না। কিন্তু শেখ মুজিব এতে রাজী হন নি। তখন প্রস্তাব দেয়া হয়- আমরা টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসি; আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা রেকর্ড করে দিয়ে যান। কিন্তু এতেও মুজিব রাজী হন নি। তখন তাজউদ্দীন ও সিরাজুল আলমরা বলেন- রেকর্ড কপি রেখে যেতে রাজী না হলে, আমাদের কাছে স্বাধীনতার একটা লিখিত ঘোষণা আছে, ওটাতে আপনি স্বাক্ষর দিয়ে যান। তখন শেখ মুজিব বলেন- ‘আমার স্বাক্ষর থাকলে পাকিস্তানীরা আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসি দিবে।’
৮. পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আত্মসমর্পণ: নিজে ও পরিবারকে নিরাপদ রাখতে প্রস্তুতি নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। স্বাধীন দেশ চাইলে স্বপরিবারে সেজেগুঁজে ও পুরো প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আত্মসমর্পন করতেন না।
৯. ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ভারতের সাথে গোলামী চুক্তি: ২৫ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২’- এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়া রাষ্ট্রগুলোর মতো পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ইত্যাদি ১৫টি দেশ কাগজে-কলমে স্বাধীন হলে, বাস্তবে কার্যত এসব দেশ বর্তমান রুশ ফেডারেশনের অধীন। রাশিয়ার কথা না শুনলে ইউক্রেনের মতো পরিণতি বরণ করার সম্ভাবনা শতভাগ।
১০. প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দুই লক্ষাধিক লোক মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষের কারণ নিয়ে বাংলাদেশের ড. মহিউদ্দীন আলমগীর (মখা আলমগীর নামে পরিচিত, যিনি আমলা ও হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী) ও ভারতীয় বাঙ্গালী অর্থনীতিবীদ অধ্যাপক গবেষণা করেন। তবে ড. অমর্ত্যসেন তাঁর মৌলিক আবিষ্কার ও অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ড. অমর্ত্যসেনের গবেষণার তথ্য ও প্রমাণ দিয়ে বলেছেন- খাদ্যঘাটতির জন্য ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ হয় নি। দুর্ভিক্ষটা হয়েছে- শেখ মুজিব সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য অর্থাৎ মানুষের খাদ্য ক্রয় করার সক্ষমতা (‘এনটাইটেলমেন্ট ওভার ফুড’) বা সামর্থ না থাকার কারণে।
১১. তুখর বক্তা হলেও শাসক হিসেবে পুরোপুরি ব্যর্থ: শেখ মুজিব বিশ্ব ইতিহাসে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তা। ৭ মার্চের ভাষণটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর দেশ চালাতে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। দেশ পরিচালনায় তাজউদ্দীনকে নিজের চেয়ে বেশি মেধাবি ও যোগ্য মনে করে হিংসা করতেন, সে কারণে তাজউদ্দীনকে কোনঠাসা করে রাখেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে যে প্রাজ্ঞ ও যোগ্য নেতৃত্ব দরকার ছিলো- শেখ মুজিবের মধ্যে তার ছিটেঁফোঁটাও ছিলো না।
দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৫ বছর জেল খাটার পর জেল থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তার সারাজীবনের বিরোধীপক্ষ বুথেলজিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শ্বেতাঙ্গ নেতাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর শেখ মুজিব রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে রাখতেই সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
এরকম আরো বহুকারণ আছে- যেজন্য শেখ মুজিব কখনো বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের মহাত্মাগান্ধী ও কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসেবে সেই সব দেশের মানুষের কাছে আজও সর্বজন স্বীকৃত ও শ্রদ্ধারপাত্র।
কিন্তু, শেখ মুজিব শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে জাতির পিতা মনে হতে পারে। আইন করে জোরপূর্বক ‘জাতির পিতা’ বাংলাদেশের সব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কাছে এখনো একজন তুখোর বক্তা হিসেবে স্বরণীয় থাকলেও ইতিহাসে একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক ও প্রশাসক, ক্ষমতালোভী এবং শিকদারসহ তৎকালীন জাসদের প্রায় ৩০ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে হত্যার নির্দেশদাতাসহ নব্য স্বাধীন দেশের (বাংলাদেশ) গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র ও গণমানুষের বাকস্বাধীনতাকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য অনেক মুজিবকে দায়ী করেন।
উপরোক্ত কারণে, শেখ মজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নেতাকর্মীদের কাছে জাতির পিতা হিসেবে অনেক পূজণীয় হলেও, বাংলাদেশের সর্বমানুষের কাছে সমানভাবে শ্রদ্ধেয় ও জাতির পিতা হিসেবে সমাদৃত নন।
লেখক- মো. রেযাউল করিম
গবেষক- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (২০০৬-’২১)
পিএইচডি কেনডিডেট- মালায়া বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মাস্টার্স- অ্যান্টিকরাপশন স্টাডিজ, অস্ট্রিয়া
লাইসেন্সড প্রডিউসার- প্রপার্টি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালটি ইন্সুরেন্স, নিউ ইয়র্ক