রোজা বা সওম কেবল পানাহার ত্যাগ করার নাম নয়। বরং এটি তাকওয়া অর্জন ও মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। পাপমুক্ত সংযত জীবন পরিচালনার অনুশীলন। অন্য সময়ের মতো সব ধরনের পাপে দিব্যি লপ্তি থেকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকাকেই রোজা বলা যায় না। কেউ যদি সত্যিই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে রোজা রাখতে চায়, তার উচিত, সব ধরনের পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে রোজা রাখা আপ্রাণ চেষ্টা করা। হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা, তদনুযায়ী কাজ করা ও মূর্খতা (অন্যায়-অবিচার) পরিত্যাগ করে না, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই।’ (বুখারি, হাদিস: ১৯০৩)
হাদিস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
প্রথমত: এই হাদিসটি রোজার উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা রোজাকে কেবলমাত্র খাদ্য-পানীয় থেকে বিরত থাকার জন্য ফরজ করেননি; বরং এর পেছনে একটি মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। নবী (সা.) এই হাদিসে মহান আল্লাহর সে উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
অর্থাৎ রোজার উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া মানে হলো, আল্লাহর বিধান মেনে চলা, তাঁর আনুগত্য করা, এবং যেসব কাজ তিনি নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়ত: হাদিসে উল্লিখিত তিনটি বিষয়:
১. ‘কওলুয-যূর’ অর্থাৎ মিথ্যা ও অনর্থক কথা বলা।
২. ‘ওয়াল-আমালু বিহি’ অর্থাৎ অনর্থক কাজ করা।
৩. ‘ওয়াল-জাহল’ অর্থাৎ মূর্খতা, যা নিজের বা অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণকেও বোঝায়।
মোটকথা, সব ধরনের পাপ ও গুনাহ ‘জাহল’ বা মূর্খতার মধ্যে পড়ে। আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা, তার মাহাত্ম্য, প্রবল শক্তি ও তার দেওয়া বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা থেকে মানুষ সাধারণত পাপ করে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর শিগগিরই তওবা করে নেয়।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৭)
উল্লিখিত আয়াতে ‘বিজাহালাতিন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যা থেকে বাহ্যত বোঝা যায়, অজ্ঞাতসারে এবং না জেনে-শুনে গোনাহ করলে তাওবা কবুল হবে এবং জ্ঞাতসারে জেনে-শুনে গোনাহ করলে তাওবা কবুল হবে না। কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম এ আয়াতের যে তাফসিরে বলেছেন এখানে ‘বিজাহালাতিন’-এর অর্থ এই নয় যে, সে গুনাহের কাজটি যে গুনাহ তা জানে না কিংবা গুনাহের ইচ্ছা নেই; বরং অর্থ এই যে, গুনাহের অশুভ পরিণাম ও পারলেৌকিক শাস্তির প্রতি তার সাময়িক অনীহাই তার গুনাহের কাজ করার কারণ ; যদিও গুনাহটি যে গুনাহ, তা সে জানে এবং তার ইচ্ছাও করে।
পক্ষান্তরে ‘বিজাহালাতিন’ শব্দটি এখানে ‘নির্বুদ্ধিতা’ ও ‘বোকামি’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, তাফসিরের সার-সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা ইউসুফে এর নজির বিদ্যমান রয়েছে। ইউসুফ (আ.) ভাইদেরকে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি জান, তোমরা ইউসুফ ও তার সহোদরের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলে, যখন তোমরা ছিলে জাহিল।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৮৯) এখানে ভাইদেরকে ‘জাহিল’ বলা হয়েছে, অথচ তারা যে কাজ করেছিল, তা কোনো ভুল অথবা ভুলে যাওয়া বশত ছিল না; বরং ইচ্ছাকৃতভাবে, জেনে-শুনেই করেছিল। কিন্তু এ কাজের পরিণতি সম্পর্কে গাফিল হওয়ার কারণে তাদেরকে ‘জাহিল’ বলা হয়েছে।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে, সে অজ্ঞ কারণ তার অজ্ঞতাই তাকে পাপের দিকে ঠেলে দেয়।’ (তাফসিরে তাবারি)
যাই হোকম নবীজির হাদিস থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝা যায়,
১. রোজাদারের জন্য গুনাহ ও পাপ কাজ বর্জন করা আরও বেশি জরুরি।
২. পাপ ও অন্যায় রোজার পূর্ণত ও মহিমা বিনষ্ট করে এবং এর সওয়াব কমিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত: রোজা হলো এমন একটি প্রশিক্ষণ, যা একজন মুসলিমকে আল্লাহর আনুগত্যে পরিচালিত করে।
তাই রোজাদারকে আল্লাহভীরুতা (তাকওয়া) অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, ফরজ ইবাদত পালনে উদাসীনতা ত্যাগ করতে হবে। সকল প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ বর্জন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করা নয়; বরং আত্মশুদ্ধি অর্জন করা, নৈতিক উন্নতি করা এবং তাকওয়া অবলম্বন করা।