নিউজ ডেস্ক:
তিন স্তরের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকাকে ঘিরে রাখা বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে চায় সরকার। দূর করতে চায় এই চার নদীর দূষণ। এ জন্য নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত কাজ শুরু হয়েছে। মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নৌবাহিনীকে। গঠন করা হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। এই টাস্কফোর্সের অধীনে গঠিত ২১ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নৌ-বাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মুহাম্মদ নিজামউদ্দিন আহমেদকে। দায়িত্ব পাওয়ার পরই নৌবাহিনী ঢাকার চারপাশ ঘিরে রাখা এই ৪টি নদীকে দূষণমুক্ত করতে তিন স্তরের পরিকল্পনা ও কিছু সুপারিশসহ একটি কর্ম পরিকল্পনা জমা দিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। এরই আলোকে তিন স্তরের মেয়াদভিত্তিক কর্ম পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করেছে নৌবাহিনী। রূপরেখা অনুযায়ী এক বছরের জন্য স্বল্পমেয়াদি, এক থেকে তিন বছরের জন্য মধ্যমেয়াদি ও এক থেকে পাঁচ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দখল মুক্ত করাসহ দূষণরোধে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশলপত্র ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ২৪ জুলাই বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ সংক্রান্ত একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করে।
নৌ-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকার এ চারটি নদী হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। এসব নদীর তলদেশে ১০ ফুটের বেশি পলিথিনসহ নানা ধরনের বর্জ্য জমে আছে। এই চারটি নদীতে ট্যানারি বর্জ্য, হাসপাতাল বর্জ্য, শিল্পবর্জ্যসহ পয়ঃবর্জ্য ফেলা হচ্ছে। নদী দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। এ কারণে নদী চারটি তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়েছে। প্রথমে নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে নদীগুলো কোনোভাবে যেন দূষিত হতে না পারে, সে জন্য বাস্তব উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এজন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ না নিলে নদীগুলো মরে যাবে। যার প্রভাব ধীরে ধীরে দেশের অন্য নদীগুলোর ওপরও পড়বে। এজন্য প্রয়োজনে লন্ডনের টেমস নদীসহ বিশ্বের যেসব নদী এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। এ কাজের জন্য নৌবাহিনী তাদের কৌশলপত্রে একটি পৃথক টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। একই সঙ্গে টাস্কফোর্সের কর্মকাণ্ড মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উপস্থাপনেরও পরামর্শ দিয়েছে।
নদী দূষণমুক্ত করতে নৌ-বাহিনীর তৈরি করা এক বছরের জন্য স্বল্প মেয়াদি পদক্ষেপে বলা হয়েছে, নদীকে দূষণ করে শুরুতেই এমন সব ময়লা উপাদান চিহ্নিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে তা পরিষ্কার করতে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ করে নদীগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে নদী খননের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। নদীর তীর সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকিতে মনিটরিং কমিটি গঠন ও তা জোরদার করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, নদীগুলো দখলমুক্ত করতে সাহসিকতার প্রয়োজন। এজন্যই এই কঠিন কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দেয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস, নৌবাহিনী মাঠে নামলে ফল যত তাড়াতাড়ি পাব, একজন সিভিলিয়ান কর্মকর্তার নেতৃত্বে এ দায়িত্ব অন্যরা পালন করতে গেলে সফলতা সেভাবে পাব না। কারণ দেশের বড় বড় রাঘববোয়ালরাই নদী দখল করে অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। এগুলো উচ্ছেদ করতে সাহস প্রয়োজন। এ সাহস নৌ-বাহিনীর আছে।
নৌ-বাহিনীর এক থেকে তিন বছরের জন্য মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার রূপরেখায় বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে নদী খননের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে। নদী তীর সংরক্ষণে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীতে যে সমস্ত ময়লা আবর্জনা বা বর্জ্য ফেলা হয়, সেসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রম নিতে হবে। নদী দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে নদীকে ঘিরে সার্কুলার ওয়াটারওয়েজ চালু করতে হবে।
পাঁচ বছর মেয়াদি কর্ম পরিকল্পনায় নৌবাহিনী বলেছে, নদী খননের সম্প্রসারিত কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
দ্রুত ঢাকা শহরের চারদিকের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করে নাব্য বাড়ানোসহ দখল মুক্ত করতে নৌবাহিনী যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোয় প্রতিদিনই পড়ছে নানা ধরনের বর্জ্য। এর ৬০ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের শিল্পবর্জ্য। নদীর নাব্য রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্সের সভায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
নৌ-বাহিনীর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পবর্জ্য। নদী চারটিতে পড়া বর্জ্যরে ৪০ শতাংশ ট্যানারি শিল্পের, ২০ শতাংশ অন্য শিল্পের। মোট ৬০ শতাংশ বর্জ্যই শিল্প খাতের। বাইরে ১৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য, ১৫ শতাংশ অন্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য। অন্য বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, ইটভাটা, পলিথিন, ডকইয়ার্ড ইত্যাদির বর্জ্য।
এতে আরো বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ঢাকা শহরের চার হাজার ৫০০ টন আবর্জনা ও ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য পড়ছে। এ ছাড়া পলিথিন জমে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ১০-১২ ফুট ভরাট হয়ে গেছে। টঙ্গী শিল্প এলাকার প্রায় ২৯টি শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন ৭ হাজার ১৫৯ কেজি শিল্পবর্জ্য গিয়ে তুরাগ নদীতে পড়ছে। আর বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী প্রতিনিয়ত দূষণ করছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আইডিইবির (ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ) ‘স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ সেল’ একটি প্রতিবেদন হস্তান্তর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। দূষণকারী কারখানার তালিকা সংযুক্ত করে সেখানে বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদী দূষণ ও দখল করেছে এক হাজার ৯৩টি শিল্প-কারখানা।
তথ্যমতে, নদী দূষণের ফলে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তাই দ্রুত ঢাকা শহরের চারদিকের নদী দূষণরোধ, নাব্য বৃদ্ধি ও অবৈধ দখলমুক্ত রাখতে স্টিয়ারিং কমিটি কাজ করবে। এর নেতৃত্ব দেবেন নৌবাহিনী প্রধান। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর ও সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলের কারণে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এর সঙ্গে দূষণ তো আছেই। তাই টাক্সফোর্স গঠন করা হয়েছে। তারা এক্ষেত্রে কাজ করবে। আর মন্ত্রণালয় সব ধরনের সহায়তা দেবে। প্রয়োজনে নদীগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশকিছু প্রকল্পও নেয়া হবে।