পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানরা ওই বর্বরোচিত ঘটনায় মদদদাতা বা পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) আবেদন করতে যাচ্ছেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমসহ আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হতে পারে। অভিযুক্তের তালিকায় থাকতে পারেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মঈন উ আহমেদসহ কয়েকজন সাবেক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা।
হাসিনা ও তাপসদের বিরুদ্ধে আইসিটিতে মামলার প্রস্তুতিশহীদদের সন্তানরা মনে করছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিদেশি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী ও পুলিশের অসৎ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ ছিল।
এ বিষয়ে কিছু তথ্য-প্রমাণও তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। আইসিটির তদন্তে তা আরও স্পষ্ট হবে এবং এ আদালতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত হবে।
এ ছাড়া পিলখানায় সেই সময় শুধু সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা নয়, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। প্রথমে মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের পরিবারের ওপর, পরে সেনা অভিযান হবে না—এই খবর প্রচারিত হলে অন্য শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের আবেদনে নিশ্চিত না হয়ে কারো নাম উল্লেখ করব না। তদন্তে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনা অসম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিডিআর সদস্যদের বড় অংশকেই ব্যবহার করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এঁদের ব্যবহার করা হয়েছে।’
শহীদ সব পরিবার এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দু-একটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও অন্য সব শহীদ পরিবারের সন্তানরা আমরা একসঙ্গে আছি।’ সাকিব রহমান বর্তমানে একজন আইনজীবী এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক।
এ বিষয়ে সাকিব রহমান বলেন, ‘দেশের যেকোনো নাগরিক আদালতে বিষয়টি নিয়ে রিট করতেই পারেন। সেটি তাঁদের বিষয়। তবে আমরা নিজেদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছি।’
সেই সব পিতৃহীন সন্তান
১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের নৃশংসতায় পিতৃহীন হন ৫৮ সেনা পরিবারের ১১০ সন্তান। চারজনের জন্ম হয় তাদের বাবারা নিহত হওয়ার কয়েক মাস পর। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বাবার আদর-সোহাগ এরা পায়নি। তা ছাড়া ওই সময় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের যেসব সন্তানের বয়স এক বছরের কম ছিল, তাদের সংখ্যাও কম নয়। এসব শিশুর কাছে তাদের বাবার স্মৃতি অস্পষ্ট।
অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের সময় ও পরে মৃত বিডিআর সদস্যদের পরিবারগুলোতেও শিশুদের একই পরিণতি। ঘটনার পর ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ২৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪০ জন অর্থাৎ ৬৯ জন জোয়ান মারা গেছেন বলে বিডিআরের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়। এঁদের মধ্যে ৯ জন আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করা হয়। এসব মৃত্যু নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিকল্পনাকারীদের আড়াল করতেই এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিনা বিচারে এসব অকালমৃত্যু চরমভাবে অনিশ্চিত করে দিয়েছে তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
সেনা পরিবারের মধ্যে নিহত মেজর সৈয়দ মো. ইদ্রিস ইকবাল, ইঞ্জিনিয়ার্সের স্ত্রী ডা. তাসলিমা রফিক জানান, মাত্র ছয় মাস বয়সী ছোট মেয়ে নুসাইবা বিনতে ইকবাল তার বাবাকে দেখার সুযোগ পায়নি। সে যখন মায়ের গর্ভে তখন তার বাবা পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হন।
নিহত মেজর মুহাম্মদ মোশারফ হোসেনের দ্বিতীয় পুত্র কামরান মো. আদিবের জন্ম হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহের তিন মাস পর ২০০৯ সালের ২৩ মে। স্বামী নিহত হওয়ার সময় কামরুন নাহার লিপি সন্তানসম্ভাবনা ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, শোকাহত অবস্থায় তাঁদের এই দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের সময় তিনি খুবই অসহায় বোধ করেন।
মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরকারের একমাত্র সন্তানের জন্ম হয় তিনি নিহত হওয়ার মাত্র ১১ দিন পর। সেই সন্তানের নাম রাখা হয় সদাকাত সাবরি বিন মমিন। আর মেজর মো. আজহারুল ইসলামের দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম হয় তিনি নিহত হওয়ার ৫১ দিন পর।
মেজর হুমায়ুন হায়দারের স্ত্রী শামীমা পারভিন জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী নিহত হওয়ার ১৪০ দিন পর তাঁদের প্রথম এবং একমাত্র পুত্রসন্তান ১২ বছরের তাসীন ঋত্বিক হুমায়ুনও মারা গেছে। দ্বিতীয় সন্তান উশিয়া আমরীন রুপন্তীও সেই অর্থে তার বাবার আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত।
পিলখানায় নিহত সেনা কর্মকর্তা মেজর মো. মিজানুর রহমানের এক আত্মীয় জানান, মিজানুর রহমানের স্ত্রী রেবেকা ফারহানা রোজী ব্রেন টিউমারের কারণে তাঁর স্বামী নিহত হওয়ার আট মাস আগেই মারা যান। মা হারানো দুই পুত্র রামী ও সামীকে নিয়ে মেজর মিজান যখন প্রায় অসহায় অবস্থায়, তখন বিডিআর সদস্যদের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
শহীদ পরিবারের এসব সন্তানের মধ্যে যারা জন্মের পর পিতৃস্নেহ পায়নি তারা এখনো বনানীর সামরিক কবরস্থানে কবরের মাটি স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করে তাদের না দেখা বাবাকে। এই সন্তানদের অনেকেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের বিচারের অপেক্ষায় আছে।
এদের মধ্যে মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের সন্তান রাকিন আহমেদ গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) একটা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর ৫৭ অফিসারকে হত্যা করেন।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ট্রায়াল বা তদন্তকে আমরা মানি না। কারণ প্রধান হত্যাকারী, নির্দেশদাতা তিনি তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কি তাঁর নিজের বিচার করবেন?’
ওই অনুষ্ঠানে রাকিন আরও বলেন, ‘এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, উনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার মা-বাবাকে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে মা-বাবার মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবে।’
তদন্ত প্রভাবিত করার একটি উদাহরণ
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ২০০৯ সালের ১১ মার্চ মারা যান বিডিআরের কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও ধর্মীয় শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান। হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয় বলে প্রচার করা হলেও তাঁর সন্তানরা মনে করেন, তিনি সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার না করায় বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
সিদ্দিকুর রহমানের মেয়ে নাওরীন সিদ্দিকী এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, “আমার আব্বু জানতেন, বিডিআরের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনেক আগে থেকে বিডিআরের বেশ কিছু সদস্য বহিরাগতদের নিয়ে মিটিং করতেন। বিষয়টি ছিল অস্বাভাবিক। রাজনৈতিক কয়েকজন নেতা অংশ নিতেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আব্বু তদন্ত কমিটির কাছে সেই মিটিংয়ের কথা উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এসব কথা আমার আম্মুর কাছে শুনেছি। কিন্তু ওই জবানবন্দি পরিবর্তন করার জন্য আব্বুর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। বেশ কয়েকবার তাঁকে যেখানে রিমান্ডে নেওয়া হয়, সেখানে এক বিডিআর সদস্যকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছিল, তা দেখিয়ে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা আব্বুকে বলেছিলেন, ‘আমাদের কথা না শুনলে আপনারও ওই অবস্থা করা হবে। আমাদের কথামতো কাজ করলে আপনার এবং আপনার স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ আমরা দেখব।’ সে সময় আব্বু একাই পিলখানার বাসায় থাকতেন। আমরা বাইরে থাকতাম। আব্বু টেলিফোনে আম্মুকে সব জানাতেন। মৃত্যুর আগের রাত ৩টায় আব্বুকে পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দের অফিসে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে বলা হয়, সরকার থেকে জবানবন্দি লিখে দেওয়া হয়েছে। এতে সই করেন। কিন্তু আব্বু বলেন, ‘আমি মিথ্যা জবানবন্দি দিতে পারব না।’ এরপর অসুুস্থ অবস্থায় আব্বুকে প্রথমে বিডিআর হাসপাতালে প্রায় তিন ঘণ্টা রাখা হয়। কিন্তু সেখানে কী চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল তা আমাদের জানানো হয়নি। পরে কড়া পাহারায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। মৃত্যুর আগে আব্বু আম্মুকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে বিষাক্ত ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, পচন ধরে গেছে, বাঁচানো যাবে না। আব্বুর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি, আমাদের আব্বু মেডিক্যাল কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন।”