নিউজ ডেস্ক:
বাহ্যিক চোখের আলো ছিল না তার। তবে অন্তর্চক্ষুর আলো ঠিকই ছিল। তাই তো তিনি হতে পেরেছেন ‘খাইরুল কুরুনি’র প্রথম সারির সদস্য। হতে পেরেছেন নবী (সা.) এর প্রিয় সহচরদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি হলেন বিখ্যাত অন্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)। ইরাকিদের কাছে তিনি আমর ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) নামে পরিচিত। ‘মাকতুম’ অর্থ অন্ধ, আর ‘উম্মে’ অর্থ মা। তার মা হজরত আতিকা (রা.) তাকে অন্ধ অবস্থায় প্রসব করেছেন। তাই তার মাকে ‘উম্মে মাকতুম’ বা অন্ধের মা উপনামে ডাকা হতো। বাবা কায়েস বিন জায়েদ আরবের বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি মায়ের নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। রিজাল শাস্ত্রে অসংখ্য সাহাবি, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈন আছেন, যারা বাবার নামের পরিবর্তে মা, দাদা, দাদি, নানা কিংবা নানির নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)ও তাদেরই একজন।
প্রখ্যাত মোহাদ্দিস ইবনে হিব্বান (রহ.) এর মতে, ‘তার নাম ছিল হুসাইন। রাসুল (সা.) পাল্টে রাখলেন আবদুল্লাহ।’ তিনি ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.) এর আপন মামাতো মতান্তরে ফুফাতো ভাই। সে হিসেবে তিনি রাসুল (সা.) এর শ্যালক হন। প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি এবং ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘তিনি একেবারেই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ ইসলাম গ্রহণের কারণে তাকেও নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। শত নিপীড়নের মুখেও তিনি দ্বীন ইসলাম থেকে এক চুল পরিমাণও সরে দাঁড়াননি। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের আদেশ আসে। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-ই ছিলেন মদিনায় হিজরতকারী প্রথম দুইজনের একজন। তার সঙ্গে আরও হিজরত করেন মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)। উম্মে মাকতুম (রা.) মুসআব (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন আর কোরআনের দাওয়াত এবং তালিমের কাজ করতেন। এ সম্পর্কে মদিনার আনসার সাহাবি হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) এর সাহাবিদের মধ্যে সর্বপ্রথম উম্মে মাকতুম এবং মুসআব (রা.) মক্কা থেকে হিজরত করে আমাদের কাছে আসেন এবং তারা এসেই আমাদের মাঝে কোরআনের তালিম শুরু করে দেন।
আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সা.)ও মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় এসে রাসুল (সা) উম্মে মাকতুম এবং বেলাল (রা.) কে মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেন। কখনও বেলাল (রা.) আজান দিতেন আবার কখনও উম্মে মাকতুম (রা.) আজান দিতেন। একজন আজান দিলে অপরজন ইকামত দিতেন। রমজানে বেলাল (রা.) সাহরির আজান দিতেন আর উম্মে মাকতুম (রা) দিতেন ফজরের আজান। এ সম্পর্কে বোখারিতে হাদিসও এসেছে। রাসুল (সা.) যখন মদিনার বাইরে যেতেন, উম্মে মাকতুম (রা.) কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। শত শত সাহাবি তার পেছনেই নামাজ পড়তেন রাসুল (সা.) এর অনুপস্থিতিতে। তিনি নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদ থেকে বাড়ি দূরে থাকা সত্ত্বেও তিনি জামাত ত্যাগ করতেন না। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ছিলেন কোরআনের হাফেজ।
এ মহান সাহাবিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব রাসুল (সা.) কে মৃদু সজাগ করেন। ঘটনাটি ছিল এরকম। একদিন রাসুল (সা.) মক্কার নেতাদের সঙ্গে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ করছিলেন। ওই বৈঠকে আবু জাহেল, উমাইয়া, উতবা, শায়বা, মুগিরার মতো বাঘা বাঘা নেতা উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় উম্মে মাকতুম এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী (সা.)! মহান আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন সে ইলম থেকে আমাকে কিছু শিখিয়ে দিন।’ রাসুল (সা.) উম্মে মাকতুমের প্রতি মনোযোগী না হয়ে নেতাদের প্রতিই মনোযোগী থাকলেন। কাফের সরদাররা অন্ধ মানুষটিকে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এ অবস্থায় রাসুল (সা.)ও উম্মে মাকতুমের প্রতি বিরক্ত হয়ে ভ্রƒকুঞ্চিত করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সঙ্গে সঙ্গে সূরা আবাসার ১-১৬নং আয়াত নাজিল করে বললেন, ‘সে ভ্রƒকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার কাছে অন্ধ মানুষটি এসেছে। হে নবী! আপনি কেমন করে জানবেন, হয়তো সে পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত।’ (সূরা আবাসা : ১-৪)।
জন্মান্ধ হওয়া সত্ত্বেও উম্মে মাকতুম (রা.) কখনও কখনও জিহাদে অংশগ্রহণ করতেন। আল ইসাবা গ্রন্থের লেখক এমনটিই বলেছেন। তিনি মানুষকে বলতেন, ‘দেখ! আমি অন্ধ। ইসলামের পতাকা হাতে আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে। অন্ধ হওয়ার কারণে পথ আমার অজানা-অচেনা। তাই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও জিহাদের ময়দান ছেড়ে পালানোর সম্ভাবনা নেই। যেমনটি তোমাদের চক্ষুষ্মানদের জন্য রয়েছে।’ বলেছেন যা, করেছেনও তা। ইবনে সাদ তার তাবাকাতে উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর আমলে কাদেসিয়ার যুদ্ধে তিনি ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে কাফেরদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। যখন তার হাতে পতাকা দেয়া হয়, তখনই তিনি বলেছেন, এ পতাকা সমুন্নত রাখব, না হয় শাহাদতের অমীয় সুধা পান করব।