জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। পাশাপাশি হতাশা ও মনোবল হারানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখনো মাঝেমধ্যে পুলিশ সদস্যরা হামলার শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি থানার ভেতরে পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, যা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে। এমনকি গ্রেফতারকৃত পুলিশ কর্মকর্তার থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর পুলিশ বাহিনীর সামাজিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সদস্যরা এখনো বিভিন্ন জায়গায় নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, সমাজে পুলিশ সদস্যদের অনেকেই এখন অপরাধীর চোখে দেখছেন, ফলে বাহিনীর সম্মান ও মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাহিনীর ভেতরে সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাবও স্পষ্ট। কেউ কার রাজনৈতিক প্রভাব, ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতা কিংবা ঘুষ বাণিজ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত হয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে ঘুষবাণিজ্যের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকেই আগের মতো বিলাসী জীবনযাপন করতে পারছেন না। যেসব সদস্য অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন, অনেকের সেই সম্পদও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত নানা সংকটের মধ্যে দিন কাটালেও পুলিশ বাহিনী ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থেকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আন্তরিক থেকে জনগণের বন্ধু হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট রয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তারা নৈতিক সংকটে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো পূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে।
বিগত সরকারের সময় পুলিশের ভিতরে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্যাডার তৈরি হয়েছিল। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করত না। যখন যা খুশি তা-ই করত। ঘুষবাণিজ্য থেকে শুরু করে অপহরণ, গুম ও দখল বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। বেপরোয়া জীবনযাপন করত। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের কারণে হঠাৎ ছন্দপতন হয় পুলিশের। কোনোভাবেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। জনগণের আস্থার জায়গায় ফিরতে পারছে না। মূলত পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অপরাধ, সেখানেই তাদের উপস্থিতি জানান দিতে হবে। এতে মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হবে, পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।’
জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীর লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলোর একটি বড় অংশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ধারণা, এসব অস্ত্র এখন দুর্বৃত্তদের হাতে রয়েছে এবং তারা এগুলো ব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অপরাধ দমন ও অভিযান পরিচালনা করতে গিয়েও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। খোয়া যাওয়া অস্ত্রের ঝুঁকি এবং অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে তারা এখনো অজানা আতঙ্কে ভুগছেন।
গত সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সামনে কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন মারধরের শিকার হয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিএনপির অসংখ্য সভাসমাবেশ ভুল করার পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের হয়রানি, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৯ জানুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল আমিন তার নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ বলছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর এবার জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থান। তৎকালীন পতিত সরকার পুলিশকে তাদের নিজেদের নানা অপকর্মে ব্যবহার করেছে। বড় একটা পরিবর্তন আসায় পুলিশের মাঝে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে। তবে বর্তমান সরকার নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশের ভেঙে পড়া ইমেজ ফিরিয়ে আনার। বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছেও। তবে এজন্য দরকার একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে পুলিশের বেপরোয়া হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। সেই সময় ঘুষবাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করায় অনেক পুলিশ সদস্য বিলাসী ও বেপরোয়া জীবনযাপন করতেন। তবে জুলাই বিপ্লবের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন আগের মতো ঘুষবাণিজ্য না থাকায় অনেকেই সেই বিলাসী জীবন ধরে রাখতে পারছেন না। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগদখলে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন অনেক পুলিশ সদস্য। কিছু সদস্যের সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করলেও কঠোর নজরদারির কারণে তাঁদের কাছে অর্থ পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। এর পাশাপাশি, সহকর্মীদের মধ্যে নানা ট্রলিংয়ের শিকারও হচ্ছেন কিছু পুলিশ সদস্য।
যদিও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন, তাঁদের অধীনে কর্মরত জুনিয়র সদস্যদের মধ্যে হতাশা বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। বেপরোয়া ভাবমূর্তি থেকে বের হয়ে ভালো পুলিশের ইমেজ ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা তেমন কার্যকর হচ্ছে না। এখনো পুলিশ বাহিনীর মধ্যে অজানা আতঙ্ক ও হতাশা বিরাজ করছে, যা বাহিনীর মনোবল এবং কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। ওই সময়ে সংঘর্ষে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং অসংখ্য সদস্য আহত হন। বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনা থেকে লুট হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় অনেক পুলিশ সদস্য আত্মগোপনে চলে যান, কেউ কেউ দেশ ছেড়েও পালিয়ে যান।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের মাঝে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য মোটিভেশনাল উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সুশীল সমাজকে। সদর দপ্তরসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এবং দেশের সব থানায় আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘আমরা অনেক বিষয়ের ওপর সুপারিশ করছি। এগুলো এখনো লেখার কাজ চলছে। তবে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য জনগণ পুলিশকে বিশ্বাস করবে। জনগণকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। ঔপনিবেশিক আমলের ধারণাটা পরিবর্তন করে পুলিশকে কল্যাণমূলক বাহিনী হিসেবে তৈরির সুপারিশ করা হবে।’