ফ্যাসিবাদী শাসনকালে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অমানবিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ অভিলাষের শিকার হয়েছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) পাঁচ মেধাবী ছাত্রী। অপরাজিতা হলে বহিরাগত তিন মেয়েসহ আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তাদের বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এমন সিদ্ধান্তে তছনছ হয়ে যায় তাদের শিক্ষাজীবন।
ভুক্তভোগীরা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট দাবি করে বলেন, ধর্মীয় অনুশাসন ও পর্দা মেনে চলার কারণে তথাকথিত সেকুলার শিক্ষকদের রোষের শিকার হয়েছিলেন তারা।
ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দুই ছাত্রী সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদনে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া জুলুমের প্রতিকার দাবি করেছেন। আবেদনে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, আটকে রাখা সার্টিফিকেট প্রদান, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং যাদের অন্যায় সিদ্ধান্তে তারা আজকের এই পরিণতিতে পৌঁছেছেন, তাদের বিচার দাবি করা হয়।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় পাঁচ ছাত্রীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার টিপু সুলতান স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাদের অবহিত করা হয়।
ওই ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর বহিরাগত তিন মেয়েসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত ছাত্রী অপরাজিতা হলে আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। এর ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বসবাস ও আচরণ-সংক্রান্ত শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ১৯(ক) ধারা অনুযায়ী তাদের বহিষ্কার করা হয়।
বহিষ্কারের শিকার ছাত্রীরা হলেন—ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজির সীমা আক্তার, ফার্মেসির মায়িশা ইসলাম, ব্যবসায় প্রশাসনের রওশন আরা খাতুন ও ফারজানা আক্তার এবং গণিতের সানজানা আফরিন বনি। এর মধ্যে সীমা আক্তার চলতি বছরের ১ জানুয়ারি এবং মায়িশা ইসলাম ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন।
সীমা আক্তার বলেন, ঘটনার দিন ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সফরে কক্সবাজার ও মহেশখালীতে ছিলেন। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষা সফর শুরু হয়েছিল ৮ নভেম্বর, যা শেষ হয় ১৭ তারিখে। তিনি কখনোই আবাসিক ছাত্রী ছিলেন না। ফলে অপরাজিতা হলের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অবান্তর। এসব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করলে তদন্ত কমিটি তাকে জানায়, তাদের কথামতো কাগজে স্বাক্ষর করলে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এরপর তাকে দিয়ে ‘আমি ইসলামী ছাত্রী সংস্থা নামক সংগঠনের একজন সদস্য’—এমন বাক্য লিখিয়ে নেয়।
সীমার দাবি, তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না; তবে কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলতেন। বহিষ্কার আদেশের পূর্বে তিনি সিজিপিএ ৩.৫৩ নিয়ে অনার্স পাস করেন। কর্তৃপক্ষ তার সার্টিফিকেট আটকে রাখে। তার বাবা হুগলী বেকারির একজন শ্রমিক। সামান্য বেতনের টাকায় সাত সদস্যের পরিবারের বোঝা বয়ে আজ তিনি শয্যাশায়ী।
সীমা মাস্টার্স করতে পারেননি। এইচএসসির সার্টিফিকেট নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট একটি চাকরি করছেন। অথচ অনার্সের সার্টিফিকেট থাকলে আজ প্রথম শ্রেণির একটি সরকারি চাকরি করতে পারতেন। লিখিত আবেদনে তিনি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, সার্টিফিকেট প্রদান, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং যাদের সিদ্ধান্তে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
মায়িশা ইসলাম তার আবেদনে উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর হলের নামাজরুমে আসরের নামাজ আদায়ের পর কয়েকজন বান্ধবীসহ কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন করেন। সেখানে বহিরাগত কেউই ছিলেন না। এরপর হলের কেয়ারটেকার এসে জানান, প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্ট তার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি নিচে এসে প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বলার সময় তার অজ্ঞাতে সহকারী প্রভোস্ট ও কেয়ারটেকার তার রুমে গিয়ে সাইমুম সিরিজের কিছু বই নিয়ে আসেন এবং তাকে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ আনা হয়।
মায়িশার অভিযোগ, তার বাবা একজন আলেম ও একটি কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ। তাকেও তদন্ত কমিটির সদস্যরা অকথ্য ভাষায় অপদস্থ করেন। তিন বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সময় ও অর্থদণ্ড দিয়ে বর্তমানে একটি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করছেন। মায়িশা তার আবেদনে তদন্ত কমিটির সভাপতি ও তৎকালীন ছাত্রবিষয়ক পরিচালক ড. অনির্বাণ মোস্তফা, অপরাজিতা হলের তৎকালীন প্রভোস্ট ড. হোসনা আরা, সহকারী প্রভোস্ট নিপা অধিকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিচার দাবি করেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনির্বাণ মোস্তফা বলেন, “এটা অনেক বছর আগের ঘটনা। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হয়নি। আপনার কিছু জানার থাকলে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলুন।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. এসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, “দুটি চিঠি সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। আগামী সিন্ডিকেট মিটিংয়ে বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করতে বলা হয়েছে। সিন্ডিকেটেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।”
























































