চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা ইট, লোহা আর সিমেন্টের অবকাঠামোটি আজ আর কেবলই একটি সেতু নয়। চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ভাষা বীর এম এ ওয়াদুদ সেতু এখন রূপ নিয়েছে এক প্রাচীন স্বপ্নের বাস্তবতায় এবং আধুনিক পর্যটন সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দুর্ভোগ পেরিয়ে যোগাযোগ, জীবনমান ও পর্যটনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এই ইসলামপুর সেতু।
দীর্ঘদিন ধরে দুই পাড়ের মানুষ অপেক্ষা করছিলেন এমন এক স্বপ্ন বাস্তবায়নের, যা একদিকে বদলে দেবে জীবনযাত্রা, অন্যদিকে খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। ২৭৪ মিটার দৈর্ঘ্যর এই সেতুটি এখন কেবল যাতায়াতের জন্য নয়, রূপ নিয়েছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে। একপাশে চাঁদপুর সদর উপজেলার ৫নং রামপুর ইউনিয়নের ছোট সুন্দর গ্রাম ও অপরূপ্রান্তে ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা ইউনিয়নের চর রণবলিয়া ইসলামপুর। এই অঞ্চলের মানুষ আগে নদীর কারণে ছিল বিচ্ছিন্ন। আত্মীয়তার সম্পর্কেও ছিল দ্বিধা, কারণ ছিল দুর্ভোগপূর্ণ পারাপার। শুধু এই দুটি এলাকা নয়, আশপাশের অন্তত আরও ২০টি গ্রামের মানুষের সেই শত বছরের দুর্ভোগ ঘুচিয়ে দিয়েছে এই সেতু। খেয়া পার হতে ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো এ দুই পাড়ের বাসিন্দাদের। কিন্তু সেতু চালু হওয়ায় মিনিটখানেকেই পেরিয়ে যাওয়া যায় দুই পাড়। পাল্টে গেছে পুরনো সেই চিত্র। তাই এখন যানবাহন ও মানুষ সেতু ব্যবহার করছেন প্রতিনিয়ত। তবে শুরুতে হালকা যানবাহন চললেও তাতেই দারুণ খুশি সেতু পারাপার হওয়া এসব মানুষগুলো। এতে দুর্ভোগ কমে যাওয়ার স্বস্তি মেলেছে তাদের মাঝে। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে মনোভাব, জীবনধারা। এখন দুই পাড়ের মানুষ একসূত্রে গাঁথা, যেন এক প্রাণ— এক আবেগ।
এদিকে ডাকাতিয়া নদীর উপর নির্মিত সবচেয়ে বড় এ দৃষ্টিনন্দন সেতুকে ঘিরে বেড়ে উঠছে পর্যটন শিল্প। সেতুর সৌন্দর্য, ডাকাতিয়া নদীর শান্ত জলধারা আর চারপাশের প্রাকৃতিক সবুজ পরিবেশ মিলিয়ে এ স্থান এখন এক নতুন পর্যটন গন্তব্য। যেকোন উৎসব, ছুটির দিনে কিংবা বিকেলবেলা প্রতিদিন পরিবার-পরিজন নিয়ে জেলা, উপজেলা সহ বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। অনেকে নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছেন, কেউ আবার সেলফি তুলছেন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। সেতুটি এখন শুধুই একটি অবকাঠামো নয়, একটি অনুভবের নাম— যেখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে মানুষের মিলনমেলা। নৌকা নির্ভর যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে আগে এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হতো ঘুরপথে। এখন সেই দিন অতীত। সেতু হওয়ার ফলে ফরিদগঞ্জের এসব এলাকার মানুষ সহজেই তাদের উৎপাদিত পণ্য মহামায়া হয়ে চাঁদপুর জেলা শহর কিংবা কুমিল্লামূখী পরিবহন করতে পারেন। এতে পরিবহন খরচ কমেছে, সময় বেঁচেছে, লাভ বেড়েছে। এমনকি জমির দামও বেড়েছে আশেপাশের এলাকায়।
সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সেতুর কাজ শেষ হলেও দুই পাড়ের ভায়াডাক্টের কাজে ছিল ধীরগতি। পরিশেষে চলতি বছরে তার সম্পন্ন হয়। দুই পাড়ের স্থানীয়দের ধারণা মতে তারা বলেন, “এই সেতু শুধু একটি যাতায়াত মাধ্যম নয়, এটি যুগের পর যুগের অবহেলিত মানুষের স্বপ্নের প্রতীক।” দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এলাকার মানুষের দাবি ও বিভিন্ন সময়ে এ সেতু প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের দুর্ভোগের কথা পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখির মাধ্যমে এই সেতু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে সেতুর দুই পাশের সড়ক আগের মতো হওয়ায় বড় ধরনের কোন যানবাহন এখনো চলাচল না করলেও সিএনজি- অটোরিকশা চলাচলে মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমেছে। এদিকে পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত এ সেতুতে প্রতিদিনই ভিড় লেগে থাকে। সেতুর উপরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভ্রাম্যমান দোকান। এ সেতু বাস্তবায়ন হওয়ায় এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। এছাড়াও এটি একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ সেতু এখন আর কেবল যোগাযোগের সেতু নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের মিলনের প্রতীক। এর সৌন্দর্য ও গুরুত্ব যেন হারিয়ে না যায় দৈনন্দিনতার ভিড়ে—এমনটাই চায় স্থানীয়রা। সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হয়ে উঠতে পারে চাঁদপুর জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার বিকেলের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করে আবার সেই পথে কিংবা দক্ষিণ দিকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা হয়ে ফেরা যায়।
ক্যাপশনঃ ডাকাতিয়া নদীর উপর নির্মিত সবচেয়ে ব্যায়বহুল চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী স্থানের দৃষ্টিনন্দন ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ সেতু।