নিউজ ডেস্ক:
১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে এমন একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো যিনি পশ্চিমা বিশ্বে চীনা সংষ্কৃতির ধারণা বদলে দিয়েছিলেন। জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন সনাতন মার্শাল আর্টের চর্চ্চা। তিনি ব্রুস লী। দিনটা ছিলো ১৯৭৩ সালের ২০শে জুলাই। সেদিন হঠাৎ করেই তরুণ অভিনেতা এবং মার্শাল আর্ট শিল্পী ব্রুস লীর মৃত্যুর খবরে সারা বিশ্বেই শোক ছড়িয়ে পড়লো।
হংকং এ কাউলুন টং-এর একটি বাড়িতে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি বলছিলেন যে তার মাথা ধরেছে এবং এজন্যে তিনি মাথাব্যাথার ওষুধও খেয়েছিলেন। তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩২ বছর।
লী ছিলেন একজন সুপারস্টার। সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো তার তরুণ ভক্তরা। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্র গতিতে তিনি যেভাবে তার হাত ও পা ছুঁড়ে দিতেন সেই স্টাইল তরুণদের বিমোহিত করতো। সারা পৃথিবীতে হাতেগোনা যতো বিখ্যাত মানুষ আছেন এই ব্রুস লী তাদের একজন যিনি পশ্চিমা ও প্রাচ্যের সংস্কৃতির মধ্যে বৈষম্য দূর করে কিছুটা মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্রুস লীর হাজার হাজার ভক্ত। এই ভক্তটি দেখতে হুবহু ব্রুসলির মতো
ব্রুস লীর মৃত্যু নাড়া দিয়েছিলো হংকং থেকে হলিউডকেও। তার মরদেহ বহনকারী কফিন দেখার জন্যে রাস্তায় নেমে এসেছিল শোকাহত হাজার হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কমিউনিটির খুবই সাধারণ লোকজনও।
ড্যান ইনোস্যান্টা একজন মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক। ব্রুস লী সারা বিশ্বে যে তিনজন ব্যক্তিকে নিজ হাতে মার্শাল আর্ট ইন্সট্রাক্টরের সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়েছিলেন তাদের একজন তিনি। একসময় তিনি ব্রুস লীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। লীর শেষ ও অসমাপ্ত ছবি- গেইম অফ ডেথেও তাকে দেখা যায়। লীর মৃত্যুর প্রায় এক দশক আগে তাদের পরিচয় হয়েছিলো।
ড্যান বলেন, ‘ব্রুস লীর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো প্রথম আন্তর্জাতিক কারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে, ১৯৬৪ সালে। অনেকেই তাকে একটু উদ্ধ্যত মনে করত। তার বয়স তখন কুড়ির ঘরে- একুশ/বাইশের মতো। তার ছিলো প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। আর সবার চেয়ে তিনি ছিলেন এগিয়ে।’
কোনো মুষ্টি বা ঘুসাঘুসি মোকাবেলা করা বা জিট কুন্ডোর ব্যাপারে ব্রুস লীর ছিলো নিজস্ব একটি দর্শন বা ধারণা। এতে মুগ্ধ হয়ে তরুণ ড্যান ইনোস্যান্টা এই কারাটে শেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে পড়েছিলেন।
এরপর ড্যান ইনোস্যান্টা ব্রুস লীর সাথে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘মার্শাল আর্ট নিয়ে ব্রুস লী সবসময় গবেষণা করতেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন। একেকটা দিন তার সবকিছু মনে হতো নতুন, একেবারে আনকোরা।’
হংকং এর দেয়ালে ব্রুস লীকে নিয়ে গ্রাফিটি বা দেয়ালচিত্র
ব্রুস লীর জন্ম হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রে, সানফ্রান্সিসকোর চায়নাটাউনে। ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর। আঠারো বছর হওয়ার আগেই তিনি বিশটির মতো ছবিতে অভিনয় করেন। প্রথম তিনি পর্দায় আসেন একজন শিশু চরিত্রে, গোল্ডেন গেইট গার্ল ছবিতে।
মার্শাল আর্টে তার ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চেষ্টার কারণে তিনি রুপালী পর্দা থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চোখে পড়েন প্রযোজক উইলিয়াম ডজিয়েরের। ১৯৬৬ সালে এবিসি টেলিভিশন সিরিজ দ্যা গ্রিন হর্নেটে তাকে দেখা যায় কেটো চরিত্রে। তার পরের বছরেই সিরিজটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দেখা গেছে, ব্রুস লী বহু ছবিতে ও টেলিভিশনে বিভিন্ন সহকারী বা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
একই সাথে তিনি মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও চালিয়ে গেছেন। কয়েকটি ছবির কোরিওগ্রাফ্রার হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। আমেরিকার বিভিন্ন ছবিতে সহকারী বা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ব্রুস লী। তিনি মনে করলেন, তার ভবিষ্যত আসলে আমেরিকায় নয়, হংকং-এ।
১৯৭১ সালে তিনি হংকং-এ চলে যান। তার গ্রিন হর্নেট ছবির জন্যে ততদিনে তিনি হংকং-এর ঘরে ঘরে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন। হংকং-এ তিনি প্রথম প্রধান একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটির নাম দ্য বিগ বস। এই ছবিটি তাকে খুব বড় ধরনের নাম এনে দেয়। বক্স অফিসেও বড় রকমের সাফল্য পায় এই ছবিটি।
১৯৭২ সালে ব্রুস লী অভিনয় করেন ফিস্ট অফ ফিউরি ছবিতে। এর আগে দ্য বিগ বস যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলো সেটিকেও ভেঙে দেয় এই ছবিটি। কিন্তু তরুণ এই অভিনেতার প্রতিভা আসলে চোখে পড়ে তার তৃতীয় সিনেমা- ওয়ে অফ দ্যা ড্রাগনে। এই ছবিটির কাহিনী লিখেছেন তিনি। পরিচালক, প্রধান তারকা এবং কোরিওগ্রাফারও ছিলেন তিনি নিজেই।
ব্রুস লীর ছবির সাফল্য তাকে জনপ্রিয় করে তোলে চীনেও। তারপর মার্শাল আর্ট ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে সারা বিশ্বে। প্রাচ্যের দেশগুলোতেও মার্শাল আর্টের নতুন এক দর্শন বা স্টাইলের সূচনা ঘটে যা পরিচিত হয়ে উঠে কুং-ফু হিসেবে।
সিয়াটলে ব্রুস লীর কবর
এরপর তার চার নম্বর ছবিটি মুক্তি পেলো। নাম- এন্টার দ্য ড্রাগন। পঞ্চম চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজ যখন চলছিল, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে কোনো কিছুই তাকে আর থামাতে পারবে না।
কিন্তু হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ১৯৭৩ সালের মে মাসে। ডাবিং করার সময়। তখন তার মস্তিস্কে এক ধরনের সমস্যা ধরা পড়ে যা চিকিৎসা শাস্ত্রে পরিচিত সেরেব্রাল এডেমো হিসেবে। ডাক্তররা তার মস্তিস্কের ফুলে ওঠা কমাতে সক্ষম হন। কিন্তু ছয় সপ্তাহেরও কম সময় পর তার মাথাব্যাথা শুরু হয়। তিনি তখন একটি পেইনকিলার বা ব্যাথানাশক ওষুধ খান যার মধ্যে ছিলো অ্যাসপিরিন ও ট্রাঙ্কুলাইজার।
ওষুধ খেয়ে তিনি বিছানায় শুতে যান। কিন্তু ব্রুস লী এরপর আর উঠতে পারেননি। তার মৃত্যুর খবরটি ড্যান ইনোস্যান্টা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রথম এই খবরটি দিয়েছিলো আমার স্ত্রী ও কন্যা। তখন আমি হংকং-এ কয়েকটি ফোন করি। প্রথমে এই খবর বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ আমরা প্রায়শই শুনতাম যে ব্রুস লীকে হত্যা করা হয়েছে। এধরনের খবরকে আমরা কোনোদিন পাত্তাও দেইনি। আমি মনে করতে পারি যে, তিনি একবার আমার বাড়িতে এসেছিলেন। বলেছিলেন যে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। তার স্বাস্থ্য দেখতে খুব ভালো ছিলো। তাই তার মৃত্যুর খবরটি আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’
ব্রুস লীর মৃত্যুর খবরে, হংকং-এ প্রত্যেকে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন নি যে এরকম অপ্রতিরোধ্য এক তরুণ আর বেঁচে নেই। তাদের নায়ককে বিদায় জানাতে হংকং-এর রাস্তায় সেদিন লাইন ধরে নেমে এলো ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ। শোকাহত ভক্তদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশের ব্যারিকেড বসাতে হয়েছিল।
তার মরদেহ রাখা হয়েছিল খোলা একটি শবাধারে, যাতে লোকজন তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে একবার হলেও শেষবারের মতো দেখতে পারেন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে, তার নিজের বাড়িতে। সেখানেও জড়ো হয়েছিলো হলিউড বা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী স্থানীয় চীনা ভক্তরা। ব্রুস লীর কফিন যারা বহন করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন ড্যান ইনোস্যান্টা।
ব্রুস লীর ভাস্কর্য
ড্যান বলেন, ‘কফিন বহনকারীদের মধ্যে আরো যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ব্রুস লীর নিজের ভাইও ছিলেন। এই কফিন বয়ে নিয়ে যাওয়াটা আমার জন্যে খুব কঠিন একটা কাজ ছিল। সেদিন আমি কিছু বলিনি। কোনো কথাই বলতে পারিনি। মনে আছে, জেমস করবিন বলেছিলো, বিদায়, বন্ধু, তোমাকে বিদায়- এধরনের কিছু। আমার মনে আছে, আমি শুধু কেঁদেছিলাম। কারণ এই লোকটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়, আমার জীবনে এরকমভাবে আর কখনই কাঁদিনি।’
ব্রুস লীর মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা আজও শোনা যায়। এর জন্যে যেসব ধারণা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অবৈধ ড্রাগ, এমনকি তার পরিবারের ওপরে অভিশাপও। তার মৃত্যুর পর এন্টার দ্য ড্রাগনের কারণে ব্রুস লী অমর হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে সব শিশু কিশোররাও মার্শাল আর্টের শিল্পী হতে আগ্রহী হয়ে উঠলো।
কুং ফু`র মতো টিভি অনুষ্ঠানগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ফ্লিনস্টোন্সের নির্মাতা হানা বারবারা মুক্তি দিলেন হংকং ফুয়ি এবং পিঙ্ক প্যানথার্স সিরিজে কেটোর মতো চরিত্র। টাইম ম্যাগাজিন তখন বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে একশোজনের নামের তালিকা তৈরি করেছিলো তাতে উঠে এলো ব্রুস লীর নাম।
লস অ্যাঞ্জেলেসের চায়নাটাউনে তার একটি ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়েছে। এত বছর পর ব্রুস লীর আবেদন আজও টিকে থাকার পেছনে ড্যান ইনোস্যান্টারও আছে নিজস্ব কিছু ধারণা। তার মতে সম্ভবত ব্রুস লী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি আমরা যার মতো হতে চাই।
তিনি বলেন, ‘একেক জনের কাছে এর পেছনে হয়তো একেক রকমের ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমার মনে হয়- তিনি প্রচুর গবেষণা করেছিলেন। ব্রুস লী ভালোবাসতেন মার্শাল আর্ট।’ড্যান স্বীকার করেছেন, তার জীবনে এরপরে এমন একটি দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেদিন তিনি ব্রুস লীকে নিয়ে একবারও ভাবেননি ।