ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের পাটপণ্যের রপ্তানি আয় কমে যাবে এমন আশঙ্কাই করছেন সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে মানভেদে প্রতি টন পাটসুতার গড় রপ্তানি মূল্য ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার। তার ওপর ১৫০ ডলার পর্যন্ত শুল্ক দিতে হলে যে দাম পড়বে, তা দিয়ে ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য কিনবেন না।
বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ৯২ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাটসুতা ৫৬ কোটি এবং চট ও পাটের বস্তা রপ্তানি আয় ১২ কোটি ডলার। পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার তুরস্ক। দ্বিতীয় হচ্ছে ভারত। সেখানে প্রায় ২ লাখ টন পাটসুতা, বস্তা ও চট রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন হচ্ছে পাটসুতা।
ভারতের গেজেট অনুযায়ী, বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানিতে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত শুল্ক দিতে হবে। ভারতীয় মুদ্রায় এই শুল্কের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে নেপালের পাটপণ্য রপ্তানির ওপর বিভিন্ন হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। তবে নেপালের পাটপণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
কোনো দেশ স্বাভাবিক দামের চেয়ে কম দামে কোনো পণ্য রপ্তানি করলে তাকে ডাম্পিং বলে গণ্য করতে পারে আমদানিকারক দেশ। এ ক্ষেত্রে তারা নিয়ম মেনে বিষয়টি তদন্ত করে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করতে পারে। গত বছর বাংলাদেশি রাসায়নিক পণ্য হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড পাকিস্তানে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের শিকার হয়।
জানা যায়, ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের তদন্ত শুরু করে দেশটির জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর প্রথম দেশটির সংশ্লিষ্ট সংস্থা ডিরেক্টর জেনারেল অব অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি) বাংলাদেশকে নোটিশ দেয়। এরপর তারা বাংলাদেশের প্রায় ২৫০ পাট রপ্তানিকারককে প্রশ্নপত্র পাঠায়। এর মধ্যে ২৬টি কোম্পানি প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ১২টি কোম্পানিকে নমুনা হিসেবে ধরে তদন্ত করেছে ডিজিএডি।
তদন্ত শেষে গত ১২ অক্টোবর সংস্থাটি বাংলাদেশকে ‘ডিসক্লোজার’ পাঠায়, যেখানে ডাম্পিংয়ের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর গত ২০ অক্টোবর তারা ফাইনাল ডিটারমিনিশন জারি করে। অর্থাৎ ডিজিএডি বাংলাদেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের সুপারিশ করে তাদের সরকারকে প্রতিবেদন পাঠায়। সে অনুযায়ী ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা ডিজিএডির কাছে এখন আপিল করতে পারবে। সেখানে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যেতে পারবে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান আহমদ হোসেনের বক্তব্য চাওয়া হলে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের ফলে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি কমে যাবে। ভারতের ওপর নির্ভরশীল অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরকারকে ভারতের উচ্চমহলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে অনুরোধ জানান চেয়ারম্যান।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিংয়ের পুরো আদেশটি দেখার পর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তিনি বলেন, ‘আগেও বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদল ভারতে গেছে। শুনানিতে অংশ নিয়েছে।’
ভারতের গেজেটে ৯টি কোম্পানির ওপর শুল্কহার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যে পাটসুতায় প্রতি মেট্রিক টনে প্রাইড জুট মিলকে ১০৪ দশমিক ১৬ ডলার, আশা জুট ইন্ডাস্ট্রিজকে ১৯ দশমিক ৩০, সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ ও আলীজান জুট মিলকে ২০ দশমিক ৩৫ ডলার, শরিফ জুট মিলসকে ১৫২ দশমিক ৮৫ ডলার, আনোয়ার জুট স্পিনিং মিলসকে ১০৯ দশমিক ৫৯ ডলার, জনতা জুট মিলসকে ২০ দশমিক ৬৮ ডলার, সিডল টেক্সটাইলস ও সাগর জুট স্পিনিংকে ১০২ দশমিক ৯৩ ডলার শুল্ক দিতে হবে। এ ছাড়া বস্তা রপ্তানিতে সিডল জুট মিলসকে ১২৭ দশমিক ৪৮ ডলার শুল্ক আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে।
যেসব মিল প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়েছে, কিন্তু নমুনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাদের ওপর পাটসুতা রপ্তানিতে প্রতি টনে ৯৭ ডলার, চটে ৩৫২ ডলার ও পাটের বস্তায় ১২৫ ডলার শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে রহমান জুট মিল, শমসের জুট মিল, গোল্ডেন জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, পূরবী ট্রেডিং, সোনালি আঁশ ট্রেডিং, রাজবাড়ী জুট, নোয়াপাড়া প্যাকেজিং, নোয়াপাড়া জুট, উষা জুট স্পিনার্স, বিএস জুট স্পিনার্স, মদিনা জুট ইন্ডাস্ট্রি, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং, জুট স্পিনার্স লিমিটেড, নওয়াব আবদুল মালেক জুট মিলস। অন্যদিকে যারা প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়নি, তাদের ওপর পাটসুতায় টনপ্রতি ১৬২ ডলার, চটে ৩৫২ ডলার ও বস্তায় ১৩৯ ডলার শুল্ক আরোপ করেছে ভারত।
ভারতে ৬০ মেট্রিক টন পাটসুতা রপ্তানির জন্য ঋণপত্র খুলেছে কাশেম জুট মিলস। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে পাটসুতা রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যেই ভারত সরকার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে কাশেম জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬০ টন পাটসুতা রপ্তানি করতে আমাদের ২০ লাখ টাকা লোকসান হয়ে যাবে। কারণ, শুল্কের অর্থ আমদানিকারক কেটে রাখবে। এভাবে তো রপ্তানি করা যাবে না। ভারতে রপ্তানি কমে যাবে।’ সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাটপণ্য রপ্তানির জন্য অন্য বাজারের দিকে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।