নিউজ ডেস্ক:
দ-বিধির ৩৭৫ ধারার ব্যতিক্রমে বলা হয়েছে, ‘১৩ বছরের কম বয়সী স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণের শামিল হবে; এ ক্ষেত্রে নাবালিকা বধূর সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের আইনে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর সঙ্গে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণের শামিল হলেও আমাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকদরিদ্র পরিবারের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে ছন্দা (ছদ্মনাম) ২০০৮ সালের ১১ মে কুষ্টিয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে এসে একটি মামলা করেন। তার আপন খালু রহিম মিয়া, খালা সাজেদা আক্তার, মূল আসামি খালেকসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করে। মামলার নালিশে আরজিতে উল্লেখ করা হয় : মূল আসামি খালেক শেখ (৫৫) তার সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়েটির খালা-খালুকে টাকা-পয়সা দিয়ে হাত করেন। ঘটনার তারিখে মেয়েটির বাবা তার ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিলেন। এ সুযোগে আসামি খালেক শেখ তার অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মেয়েটির খালা-খালুসহ সন্ধ্যা ৭টায় তাদের বাড়িতে আসেন এবং নিকাহ রেজিস্ট্রার আসামি আরব বিশ্বাস ও মওলানা আইয়ুব আলীকে ডেকে রাত ৮টায় বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পন্ন করেন। ওই সময় মেয়েটির মা উপস্থিত ছিলেন এবং তার সম্মতিতে দাদার বয়সী লোকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে সম্পন্ন হয়। এরপর আসামিরা মাইক্রোবাস ভাড়া করে মেয়েটিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের কু-ুপাড়ার বসতবাড়িতে নিয়ে আসেন। ওই দিন রাতে আসামি খালেক শেখ জোর করে তার নাবালিকা স্ত্রী (১৩) ছন্দার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু মেয়েটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রচ-ভাবে বাধা দেয়। আসামি খালেক শেখ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চাপাচাপি ও বল প্রয়োগের একপর্যায়ে ভিকটিমকে চড়-থাপ্পড় মারেন। মামলার ঘটনা থেকে আরও জানা যায়, এরপর মেয়েটিকে ঢাকার গাবতলীর একটি বাসায় নিয়ে যান এবং সেখানেও অনুরূপভাবে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরের দিন সুযোগ বুঝে ঢাকার গাবতলীর ওই বাসা থেকে মেয়েটি পালিয়ে ঢাকার মহিলা আইনজীবী সমিতিতে আশ্রয় নেয় এবং রমনা থানায় একটি জিডি এন্ট্রি করে।
মেয়েটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর উপরিউক্ত ঘটনা উল্লেখ করে আরও বলে, আসামির আরও দুজন স্ত্রী আছে। মামলার শুনানিকালে আরও জানা যায়, মেয়েটির পরিবারের হতদরিদ্রতার সুযোগে আসামি খালেক শেখ মেয়েটির পরিবারের নামে জমি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে তৃতীয় বিবাহ করেন। মেয়েটির সঙ্গে ওই আসামির বিয়ে হওয়ায় এবং পরে আপস সাক্ষ্য দেয়ায় আসামি খালেককে অপহরণ ও ধর্ষণের দায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত সাজা দিতে পারেনি।
আমাদের দেশে এ ধরনের নাবালিকা বিয়ে হামেশা হচ্ছে। বিশেষ করে হতদরিদ্র পরিবারগুলোয় এ ধরনের নাবালিকা বিয়ের প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অভিভাবকদের অশিক্ষা, সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভরণপোষণ দেয়ার অক্ষমতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সাধারণত অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন এবং তাদের স্বামী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। ফলে আইন না জানা কিংবা লোকলজ্জা ও সামাজিক অনিরাপত্তার কারণে দিনের পর দিন এ দেশের নাবালিকা বধূরা যৌন নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে।
বাল্যবিবাহ প্রশ্নে তিন পক্ষই সমান অপরাধী
ক) ‘বাল্যবিবাহ’ বলতে ওই বিবাহকে বোঝাবে যাতে পক্ষদ্বয়ের যে কোনো একজন ‘শিশু’ বা নাবালক হবে। খ) ‘শিশু’ বা নাবালক বলতে ওই ব্যক্তিকে বোঝাবে যার বয়স পুরুষ হলে ‘একুশ’ বছরের কম এবং নারী হলে ‘আঠারো’ বছরের নিচে হবে; গ) ‘বিয়ের পক্ষ’ বলতে যে দুজনের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, অথবা হতে চলেছে এমন যে কোনো একজনকে বোঝাবে।
বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনো কখনো তা অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়। বিশেষ করে যখন সেটি বাল্যবিয়ের পর্যায়ে পড়ে। এটি আইনত নিষিদ্ধ হলেও আমাদের সমাজে হামেশাই হচ্ছে। যার পরিণতিতে কিশোরী মায়েরা পড়ছে নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। বিশ্বের যে কটি দেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রচলন খুব বেশি। কারণ গ্রামের দরিদ্র মানুষ তাদের দারিদ্র্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ কাজের লোকের অভাব পূরণের জন্য অল্প বয়সের ছেলেকে বিয়ে করান। এরকম আরও অনেক কারণে গ্রামে বাল্যবিবাহের বিস্তার ঘটে। সরকার অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা, উপবৃত্তি ইত্যাদি ব্যবস্থা করার পরও এর হার কমছে না। বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় এবং গত দুই দশক এর হার প্রায় একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইউএনএফপির গবেষণা মতে, উন্নয়নশীল দেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৮ কোটি ২০ লাখ কন্যাশিশুর বিয়ে হয় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে। আর এদেরই মানসিক, শারীরিক ও যৌন জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাল্যবিবাহের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে এবং এর ফলে সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ কমছে। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে কায়িক পরিশ্রমের কারণে প্রায় ৫৫ শতাংশ কন্যাশিশু মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে। তাদের গবেষণায় আরও দেখা যায়, কন্যাশিশুকে সামাজিক নিরাপত্তা না দিতে পারা, বিয়ের প্রস্তাব বা কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এসিড সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয়েও বাল্যবিবাহ দেয়া হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও বাড়ছে যখন দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে বরের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে কনের বয়স ১৩ বছরের মধ্যে।
বাল্যবিবাহের শাস্তি
এক মাস মেয়াদ পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- কিংবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকারের দ-ই হতে পারে। এ শাস্তি বাল্যবিবাহকারীর, বিবাহসম্পন্নকারীর এবং অভিভাবকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ বিবাহ আয়োজনকারী, যারা বিবাহ আয়োজনে জড়িত থাকবে তাদের ক্ষেত্রেও এই শাস্তি প্রযোজ্য। এ আইনে সংঘটিত কোনো অপরাধ সম্পূর্ণভাবেই ফৌজদারি অপরাধ। সুতরাং নিঃসন্দেহে এর বিচার পদ্ধতি ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের আওতাভুক্ত। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬০(এফ) (ক) ধারার অধীন অনূর্ধ্ব ছয় মাস মেয়াদের কারাদ-যোগ্য অপরাধগুলোর বিষয় সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে এর বিচার ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২৬০(ক) ধারার আওতাভুক্ত হবে।
বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী সাহেবের দায়-দায়িত্ব
১. নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী বা পুরোহিত বিবাহসম্পন্ন করার আগে ছেলে ও মেয়ের বয়স সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধান করবেন এবং এই মর্মে পরিতুষ্ট হবেন, বর বা কনের কেউ শিশু বা নাবালক নয়। ২. বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কাজী সাহেব বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন না। এ ব্যাপারে ইমাম সাহেবদের বিয়ে পড়ানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেবেন কাজী সাহেব। ৩. কাজী সাহেব বয়স নিশ্চিত হওয়ার জন্য বর ও কনে উভয়েরই বয়সের সার্টিফিকেট চাইতে পারেন। অর্থাৎ বয়স নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাজী সাহেব যে কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন। প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী কাজী সাহেবকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ৪. কাজী সাহেব বাল্যবিবাহের আইনগতদিক তুলে ধরে জনগণের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করবেন। বাল্যবিবাহের ফলে ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে কী কী খারাপ প্রভাব পড়ে সে ব্যাপারে কাজী এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবসহ সমাজের সবাই সচেতন ব্যক্তিরা সচেতনতা সৃষ্টি করবেন।
একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত
একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ইয়ামিনি দেশের ১০ বছরের বালিকা বধূ নুজুত আলী। দরিদ্র বাবা মোহাম্মেদ আদাল তাকেও বাংলাদেশি মেয়ে ছন্দার মতো তিনগুণ বয়সী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেন। নুজুতের বাবারও দুটি স্ত্রী ছিল এবং দুই সংসারে তার মোট ১৬ জন ছেলেমেয়ে ছিল। বাংলাদেশের মেয়ে রূপার ঘটনা আমাকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ্ব আলোড়িত ১০ বছরের ইয়ামিনি বালিকা বধূ নুজুত আলীর কথা। নুজুত আলীর দরিদ্র বাবা মোহাম্মেদ আদাল তাকেও তিনগুণ বয়সী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেন। নুজুতের বাবা দুটি বিয়ে করেন এবং দুই সংসারে তার মোট ১৬ জন ছেলেমেয়ে ছিল। ৩০ বছর বয়সী নুজুতের স্বামী মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। সে প্রায়ই নুজুতকে মারধর করতেন এবং জোরপূর্বক তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাধ্য করতেন। মা-বাবাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছে নুজুত আলী, যাতে তাকে ওই পাষ- স্বামীর ঘরে না যেতে হয়। কিন্তু তার মা-বাবা তার কথায় কোনো রকম কর্ণপাত করেননি। শেষমেশ ১০ বছরের বালিকা বধূ নুজুত আলী আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল তালাকের আদেশের জন্য এবং মানবাধিকারকর্মী শাদা নাসের নামের একজন ইয়ামিনি আইনজীবী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মামলাটি তার হাতে নেন এবং নুজুত আলীকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তারপর থেকেই নুজুত আলী বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়ে যায়, ‘স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১০ বছর বয়সী এক গৃহবধূ তালাক চায়।’ তাকে নিয়ে লেখা বই ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়। বিশ্বখ্যাত গ্লামার ম্যাগাজিন ২০০৮ সালে নুজুত আলীকে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ বলে ঘোষণা করে। পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক খেতাবে ভূষিত করা হয় নিউইয়র্কের এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ওই অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও উপস্থিত ছিলেন। ২০০৮ সালে নুজুত আলী আদালতের মাধ্যমে তালাকের আদেশপ্রাপ্ত হয়। বিচারক তার আদেশে বলেছিলেন, ‘তুমি চাইলে তালাক না দিয়ে ৩/৪/৫ বছর পর স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে পারো।’ এ প্রস্তাবটি শুনে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বালিকা বধূটি। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘৃণাভরে উচ্চারণ করেছিল, ‘না, আমি অমন পাষ-র সঙ্গে থাকতে চাই না। আমি স্বাধীনতা চাই; আমি আমার কৈশোরে ফিরে যেতে চাই।’