সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি ঃ সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার মাছুয়াকান্দি গ্রামের রোকেয়া বেগম (৪৫) দীর্ঘশ্বাস আর বোঁবা কান্না যেন আর থামে না। যমুনাকে দেখিয়ে তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘ওই আমারে সর্বনাশ করেছে। বসতঘর, ফসলি জমি সব কিছু গ্রাস করেছে।’ তিনি গত শনিবার হারিয়েছেন তার ঘর। সহায়-সম্বল হারিয়ে তিনি আজ নিঃস্ব। অথচ এক সময় তিনি গেরস্ত ঘরের বৌ ছিলেন। যমুনার করাল গ্রাসে সব হারিয়ে ওই বৃদ্ধা এখন আশ্রয় নিয়েছেন ওয়াপদার বেড়িবাঁধে। এমনই গৃহহারা হাজারও মানুষ। তবে বর্তমান সরকার ভাঙন রোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
যমুনার সর্বগ্রাসী থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে কাজিপুর সদর, গান্ধাইল, শুভগাছা ও মাইজবাড়ী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। এ ছাড়া খাসরাজবাড়ী, নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ ও মনসুর নগর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম তীব্র ভাঙনের শিকার। ১৯৫৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজিপুরে ভাঙন প্রতিরোধে ছোট-বড় অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সলিড স্পার অনেক বছর টিকে ছিল। কিন্তু ৫-৬ বছর আগে তীব্র ভাঙনের মুখে সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে মাজনাবাড়ীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ গত মঙ্গলবার বিলীন হয়ে যায় যমুনা নদীগর্ভে। বর্তমানে ছয়টি স্পটে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। যমুনার এমন তাগুবে নদীশিকস্তি মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাপ-দাদার বসতভিটা আর সহায়-সম্পদ হারিয়ে তারা এখন বড় অসহায়। নদীর পূর্বপাড়ে ভাঙন ক্রমেই ধেয়ে আসায় আশপাশের লোকালয়ে আতস্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের তীব্র বাতাসের কারণে নদীর ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বর্ষার পানি। গত কয়েকদিনে শুভগাছা, খাসরাজবাড়ী, মনসুরনগর, কাজিপুর সদর ও চরগিরিশ এলাকার আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ যমুনা গ্রাস করে নিয়েছে। প্রায় দুই কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ, দোকানপাট, ১টি স্কুল, ১টি মসজিদ, কয়েকশ’ বসতঘর, ফসলি জমি, গাছগাছালির বাগান বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে শুভগাছা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। ফুলজোড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, এবারের বর্ষায় ফুলজোড় স্কুল যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের অবশিষ্ট অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিয়ারা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরুল ইসলাম জানান, ভাঙনের তাড়া খেয়ে এ পর্যন্ত তারা ৩ বার ঘরবাড়ী পিছিয়েছেন। আগামীতে কোথায় যাবেন সেই ঠিকানাও খুঁজে পাচ্ছে না।
কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার, ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা হক জানান, নদীভাঙনে তার পরিবার ৫-৬ বার জায়গা বলদ করেছে। এখন বাধ্য হয়েই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্গম মধ্যেই আছেন। ৩৬৮.৬৩ বর্গকিলোমিটারের জনপদ কাজিপুরের তিনভাগই যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র তিনটি। আবার যমুনার পূর্বপাড়ে বেশ কয়েকটি চর জেগে উঠলেও চরের মালিকানা নিয়ে ভূমিহীন-জোতদারের মধ্যে চলছে বিরোধ। নদীশিকস্তি পরিবারগুলো সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়ছে।
এদিকে শুভগাছা, গান্ধাইল ও কাজিপুর সদর ইউনিয়নের প্রায় প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই বছরের ভাঙনে এসব এলাকার প্রায় এক হাজার বসতঘর, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও ১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১টি মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দক্ষিণ শুভগাছা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বাঁস ও গাছের ডালপালা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাজনাবাড়ীতে ভাঙন ঠেকাতে ওই এলাকায় মানুষ হাজার হাজার বালির বস্তা ও বাঁশ দিয়ে বাঁধ তৈরি করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এলাকার আমিনুল ইসলাম মাষ্টার, শাহজাহান আলী, মজনু, আবুল কালাম, কাশেম, সোহেল মেম্বার জানান, নারী-পুরুষ মিলে হাতের কাছে যা পাচ্ছেন, তাই নদীতে ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন।