শিরোনাম :
Logo আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস ২০২৫ উপলক্ষে কয়রায় র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত Logo দর্শনা থানা পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযান, ৪ কেজি গাঁজাসহ আটক ১ Logo জীবননগরে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২৫ উদযাপন Logo আইএফএডিকে বাংলাদেশের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠনের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার Logo চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহ এলাকায় বিষাক্ত মদপানে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। Logo ভাতগ্রামে ফ্রী রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হল Logo চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। Logo বিগত তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের বিরত রাখা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Logo কয়রায় মায়ের সঙ্গে অভিমানে ৯ বছরের স্কুলছাত্রী আছিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু Logo জাতীয় পতাকা ও সংগীত অবমাননাকারি সুন্দরগঞ্জের মিরাজ আটক : মামলা দায়ের
ইসলাম জীবন

মাহে রমজান এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা

|| ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ||

বিশ্বে এ মুহূর্তে মুসলমানের সংখ্যা ১৫০ কোটির বেশি। যা বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। এই জনসংখ্যার সবল ও সাবালক সদস্যদের জন্য মাহে রমজানের রোজা রাখা আবশ্যক। বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের হিসাবমতে, পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে ভোগে। ১৩টি ইসলামি দেশে ১২ হাজার ২৪৩ জন ডায়াবেটিক রোগীর ওপর পরিচালিত ‘এপিডিমাইওলজি অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড রমজান’ (২০১১) শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৩ ভাগ টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগী এবং ৭৯ ভাগ টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগী মাহে রমজানে রোজা রেখে থাকে। এই হিসাবে ৪০-৫০ মিলিয়ন মুসলমান ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখে।

চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী, রমজান মাসে ২৯-৩০ দিন রোজা পালিত হয়। ভৌগোলিক ও ঋতুভেদে মোটামুটি ১৫-২০ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়। সুবহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওষুধ সেবনসহ সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। সূর্যাস্তের পরে অবশ্য আবার স্বাভাবিকভাবে খাওয়াদাওয়া করা যায়। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে সুবহ সাদেক পর্যন্ত সময়ে পানাহারের সুযোগ আছে আর সুবহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো কিছু গ্রহণ করা চলে না। মাহে রমজানে রোজা পালনের আবশ্যিক এ বিধান এ মাসে ‘অসুস্থ’ আর ‘মুসাফির’দের জন্য শিথিল করে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটিও যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সিয়ামসাধনার এ সুযোগকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য ‘সহজ করতে চান’ তিনি ‘কোনো জটিলতা কামনা করেন না’। রোজা পালন একজন ব্যক্তির জন্য যাতে অনাবশ্যক অসুবিধাজনক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার বিধান রয়েছে। পবিত্র কোরআনে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিচর্যার স্বার্থে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা বা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার এ দৃষ্টিতে একজন অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা বিধানার্থে পানাহারের বিকল্প নয়, এমন পর্যায়ের প্রতিষেধক গ্রহণেও সম্মতি রয়েছে। যেমন রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করা এমনকি প্রয়োজন হলে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞ আলেমগণ অভিমত দিয়েছেন এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রোজায় ডায়াবেটিক রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তুলনায় উপকৃতই হন বেশি। দেখা গেছে, রোজার সময়ে সাহরিতে সর্বশেষ খাদ্যগ্রহণের মোটামুটি আট ঘণ্টা পর শরীর প্রাকৃতিকভাবেই যকৃতে সঞ্চিত গ্লুুকোজ ব্যবহার করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় গ্লুুকোজের মাত্রা কমে এলে চাপ পড়ে সঞ্চিত চর্বির ওপর। এভাবে দেহের সঞ্চিত চর্বি কমে বাড়তি ওজনও, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। চিকিৎসার সঙ্গে পরামর্শক্রমে ওষুধ সেবন এবং ইনসুলিন গ্রহণের সময়সীমা ও মাত্রা পূর্ণ নির্ধারণ করিয়ে নিয়ে এবং অন্যান্য পরামর্শ সমন্বয় করিয়ে নিয়ে একজন ডায়াবেটিক রোগী অনায়াসে রোজা রাখতে পারেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যারা রোজা রাখেন, তারা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষ করে (১) রক্তে সুগারের স্বল্পতা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া, (২) রক্তে সুগারের আধিক্য বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া, (৩) ডায়াবেটিস কিটো এসিডোসিস এবং (৪) পানিশূন্যতা বা ডি-হাইড্রেশনে ভুগতে পারেন। সাধারণত শুধু খাবার আর ব্যায়ামের মাধ্যমে যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাদের রোজা রাখায় কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি নেই। যারা মেটফরমিন, গ্লিটাজোনস কিংবা ইনক্রিটিনজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের হাইপো হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। যারা ইনসুলিন কিংবা সালফোনাইল গ্রহণ করেন তাদের হাইপো হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা হলেও থাকে। ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিক রোগী রোজার আগের চেয়ে রোজার সময় বরং ভালো বোধ করেন, রক্তের শর্করা ভালো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। শুধু প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন।

ডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে- (১) রোজার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাগুলো এবং এর উত্তরণের উপায়সমূহ আগেভাগে জেনে নেওয়া, (২) হাইপো না হওয়ার জন্য খাদ্য, ব্যায়াম এবং ওষুধের সমন্বয় করে নেওয়া, (৩) প্রয়োজনে দিনে-রাতে সুগার পরিমাপ করা। রোজা রেখে সুগার মাপলে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না বলে বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত রয়েছে। ওষুধ কিংবা ইনসুলিন সমন্বয়ের বিষয়টি রোগী ও রোগীর পরিবারের সবাইকে অবগত রাখা; (৪) তিনবারের ওষুধ দুই বা একবারে পরিবর্তন করে নেওয়া, (৫) রোজা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকে দুপুরের ওষুধ রাতে খাওয়া শুরু করা, (৬) রোজা শুরুর আগে নফল রোজা রেখে প্রস্তুতি নিতে পারেন।

সাহরি ও ইফতার রোজার দুই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে এ দুটি পর্যায়েরও রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। মহানবী (সা.) সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বা খুবই পছন্দনীয় কাজ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত রোজা রাখার জন্য শেষ রাতে কিছু পানাহার করা চাই। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। সাহরি খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যে লোক রোজা রাখতে চায়, তার কিছু খেয়ে সাহরি পালন করা কর্তব্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমানদের ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার একটি পার্থক্য হলো, সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানগণ সাহরি খেয়ে রোজা রাখে আর অমুসলমানরা সাহরি না খেয়ে রোজা থাকে।’

কোরআন মাজিদের দ্বিতীয় সুরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘…পানাহার কর যে পর্যন্ত প্রত্যুষে কালো রেখা হতে সাদা রেখা প্রকাশ হয়’ অর্থাৎ সুবহ সাদেক উদয় হওয়া পর্যন্ত সাহরি খাওয়ার শেষ সময়। এই শেষ সময় পর্যন্ত সাহরি খাওয়া বিলম্ব করাই সুন্নাত-রসুলের আদর্শ। তিনি সাহরি খাওয়ার জন্য যেমন তাগিদ দিয়েছেন তেমনি তা বিলম্বিত করার জন্য শেষ মুহূর্তে খাওয়ার জন্যও উৎসাহিত করেছেন। সুবহ সাদেক উদয় হওয়ার বহু পূর্বে প্রায় মধ্যরাতে সাহরি খাওয়া

ইসলামে পছন্দনীয় কাজ নয়। তাবরানি সংকলিত হাদিস গ্রন্থের একটি হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রাতের শেষ দিকে সাহরি গ্রহণ কর।’ পূর্বেই বলা হয়েছে, সাহরি খাওয়া সুন্নতে মুস্তাহাব, ফরজ নয়। কোনো কারণবশত সাহরি খাওয়া সম্ভব না হলে ফরজ রোজা থাকা থেকে বিরত থাকা বিধেয় নয়।

হজরত আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মত যত দিন ইফতার ত্বরান্বিত করবে এবং সাহরি বিলম্বিত করবে তত দিনে তারা কল্যাণকর হয়ে থাকবে।’ সূর্যাস্তের মুহূর্তে ইফতার করার সময়। এ মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্রই রোজা খুলে ফেলা কর্তব্য। ইফতার করতে অকারণ বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। যদি কেউ এ বিলম্বকে অধিক সওয়াব পাওয়ার উপায় কিংবা অধিক তাকওয়া দেখাবার শামিল মনে করেন, তা আদৌ সঠিক নয়। ইফতার ত্বরান্বিত করা কেবল রসুল (সা.)-এর পছন্দ নয়, আল্লাহর কাছেও তা অধিকতর প্রিয়। হাদিসে কুদসিরূপে উল্লেখিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমার কাছে ওই ব্যক্তি সর্বাধিক প্রিয় যে শিগগির ইফতার করে।’ হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতকে রমজান মাসে পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করা হয়, যা আগের কোনো উম্মতকে দেওয়া হয়নি। সে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হলো- (১) রোজাদারের মুখনিঃসৃত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি হতেও উত্তম; (২) যতক্ষণ না ইফতার করে ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন; (৩) আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক দিন তাঁর জান্নাতকে সুসজ্জিত করে রাখেন; অতঃপর জান্নাতকে (সম্বোধন করে) বলতে থাকেন: আমার নেক বান্দাদের বৈষয়িক শ্রম, দায়িত্ব ও কষ্ট নির্যাতন শিগগিরই দূর করা হবে। (৪) তারা আমার কাছে শুভ পরিণতি পাবে। (৫) এ মাসে প্রধান দুষ্কৃতকারী শয়তানকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হবে। ইফতারের সময় ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু’ র্অথাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনার জন্য আমি রোজা রেখেছি, আপনার রিজিকের দ্বারা ইফতার করছি’ এই দোয়া পড়া সুন্নাত। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।’

সিয়ামসাধনার ফলে রোজাদারের জীবনযাপন প্রণালি শৃঙ্খলামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যথামুহূর্তে ইফতার করা এবং শেষ রাতে সাহরি খাওয়া সেই শৃঙ্খলা বিধান ও নিয়মতান্ত্রিকতারই অংশ। ইফতার করার আগে ইফতারসামগ্রী সামনে নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করার মধ্যে ধৈর্যশীলতা ও নিয়মনিষ্ঠার পরিচয় নিহিত। সাহরি ও ইফতার উভয়ই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক : সাবেক সচিব, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস ২০২৫ উপলক্ষে কয়রায় র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ইসলাম জীবন

মাহে রমজান এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা

আপডেট সময় : ১১:৪২:২৪ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২ মার্চ ২০২৫

|| ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ||

বিশ্বে এ মুহূর্তে মুসলমানের সংখ্যা ১৫০ কোটির বেশি। যা বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। এই জনসংখ্যার সবল ও সাবালক সদস্যদের জন্য মাহে রমজানের রোজা রাখা আবশ্যক। বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের হিসাবমতে, পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে ভোগে। ১৩টি ইসলামি দেশে ১২ হাজার ২৪৩ জন ডায়াবেটিক রোগীর ওপর পরিচালিত ‘এপিডিমাইওলজি অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড রমজান’ (২০১১) শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৩ ভাগ টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগী এবং ৭৯ ভাগ টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগী মাহে রমজানে রোজা রেখে থাকে। এই হিসাবে ৪০-৫০ মিলিয়ন মুসলমান ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখে।

চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী, রমজান মাসে ২৯-৩০ দিন রোজা পালিত হয়। ভৌগোলিক ও ঋতুভেদে মোটামুটি ১৫-২০ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়। সুবহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওষুধ সেবনসহ সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। সূর্যাস্তের পরে অবশ্য আবার স্বাভাবিকভাবে খাওয়াদাওয়া করা যায়। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে সুবহ সাদেক পর্যন্ত সময়ে পানাহারের সুযোগ আছে আর সুবহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো কিছু গ্রহণ করা চলে না। মাহে রমজানে রোজা পালনের আবশ্যিক এ বিধান এ মাসে ‘অসুস্থ’ আর ‘মুসাফির’দের জন্য শিথিল করে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটিও যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সিয়ামসাধনার এ সুযোগকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য ‘সহজ করতে চান’ তিনি ‘কোনো জটিলতা কামনা করেন না’। রোজা পালন একজন ব্যক্তির জন্য যাতে অনাবশ্যক অসুবিধাজনক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার বিধান রয়েছে। পবিত্র কোরআনে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিচর্যার স্বার্থে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা বা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার এ দৃষ্টিতে একজন অসুস্থ ব্যক্তির সুস্থতা বিধানার্থে পানাহারের বিকল্প নয়, এমন পর্যায়ের প্রতিষেধক গ্রহণেও সম্মতি রয়েছে। যেমন রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করা এমনকি প্রয়োজন হলে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞ আলেমগণ অভিমত দিয়েছেন এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রোজায় ডায়াবেটিক রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তুলনায় উপকৃতই হন বেশি। দেখা গেছে, রোজার সময়ে সাহরিতে সর্বশেষ খাদ্যগ্রহণের মোটামুটি আট ঘণ্টা পর শরীর প্রাকৃতিকভাবেই যকৃতে সঞ্চিত গ্লুুকোজ ব্যবহার করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় গ্লুুকোজের মাত্রা কমে এলে চাপ পড়ে সঞ্চিত চর্বির ওপর। এভাবে দেহের সঞ্চিত চর্বি কমে বাড়তি ওজনও, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। চিকিৎসার সঙ্গে পরামর্শক্রমে ওষুধ সেবন এবং ইনসুলিন গ্রহণের সময়সীমা ও মাত্রা পূর্ণ নির্ধারণ করিয়ে নিয়ে এবং অন্যান্য পরামর্শ সমন্বয় করিয়ে নিয়ে একজন ডায়াবেটিক রোগী অনায়াসে রোজা রাখতে পারেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যারা রোজা রাখেন, তারা বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষ করে (১) রক্তে সুগারের স্বল্পতা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া, (২) রক্তে সুগারের আধিক্য বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া, (৩) ডায়াবেটিস কিটো এসিডোসিস এবং (৪) পানিশূন্যতা বা ডি-হাইড্রেশনে ভুগতে পারেন। সাধারণত শুধু খাবার আর ব্যায়ামের মাধ্যমে যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাদের রোজা রাখায় কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি নেই। যারা মেটফরমিন, গ্লিটাজোনস কিংবা ইনক্রিটিনজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের হাইপো হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। যারা ইনসুলিন কিংবা সালফোনাইল গ্রহণ করেন তাদের হাইপো হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা হলেও থাকে। ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিক রোগী রোজার আগের চেয়ে রোজার সময় বরং ভালো বোধ করেন, রক্তের শর্করা ভালো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। শুধু প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন।

ডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে- (১) রোজার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাগুলো এবং এর উত্তরণের উপায়সমূহ আগেভাগে জেনে নেওয়া, (২) হাইপো না হওয়ার জন্য খাদ্য, ব্যায়াম এবং ওষুধের সমন্বয় করে নেওয়া, (৩) প্রয়োজনে দিনে-রাতে সুগার পরিমাপ করা। রোজা রেখে সুগার মাপলে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না বলে বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত রয়েছে। ওষুধ কিংবা ইনসুলিন সমন্বয়ের বিষয়টি রোগী ও রোগীর পরিবারের সবাইকে অবগত রাখা; (৪) তিনবারের ওষুধ দুই বা একবারে পরিবর্তন করে নেওয়া, (৫) রোজা শুরুর কয়েক দিন আগে থেকে দুপুরের ওষুধ রাতে খাওয়া শুরু করা, (৬) রোজা শুরুর আগে নফল রোজা রেখে প্রস্তুতি নিতে পারেন।

সাহরি ও ইফতার রোজার দুই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে এ দুটি পর্যায়েরও রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। মহানবী (সা.) সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বা খুবই পছন্দনীয় কাজ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত রোজা রাখার জন্য শেষ রাতে কিছু পানাহার করা চাই। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। সাহরি খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যে লোক রোজা রাখতে চায়, তার কিছু খেয়ে সাহরি পালন করা কর্তব্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমানদের ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার একটি পার্থক্য হলো, সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানগণ সাহরি খেয়ে রোজা রাখে আর অমুসলমানরা সাহরি না খেয়ে রোজা থাকে।’

কোরআন মাজিদের দ্বিতীয় সুরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘…পানাহার কর যে পর্যন্ত প্রত্যুষে কালো রেখা হতে সাদা রেখা প্রকাশ হয়’ অর্থাৎ সুবহ সাদেক উদয় হওয়া পর্যন্ত সাহরি খাওয়ার শেষ সময়। এই শেষ সময় পর্যন্ত সাহরি খাওয়া বিলম্ব করাই সুন্নাত-রসুলের আদর্শ। তিনি সাহরি খাওয়ার জন্য যেমন তাগিদ দিয়েছেন তেমনি তা বিলম্বিত করার জন্য শেষ মুহূর্তে খাওয়ার জন্যও উৎসাহিত করেছেন। সুবহ সাদেক উদয় হওয়ার বহু পূর্বে প্রায় মধ্যরাতে সাহরি খাওয়া

ইসলামে পছন্দনীয় কাজ নয়। তাবরানি সংকলিত হাদিস গ্রন্থের একটি হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রাতের শেষ দিকে সাহরি গ্রহণ কর।’ পূর্বেই বলা হয়েছে, সাহরি খাওয়া সুন্নতে মুস্তাহাব, ফরজ নয়। কোনো কারণবশত সাহরি খাওয়া সম্ভব না হলে ফরজ রোজা থাকা থেকে বিরত থাকা বিধেয় নয়।

হজরত আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মত যত দিন ইফতার ত্বরান্বিত করবে এবং সাহরি বিলম্বিত করবে তত দিনে তারা কল্যাণকর হয়ে থাকবে।’ সূর্যাস্তের মুহূর্তে ইফতার করার সময়। এ মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্রই রোজা খুলে ফেলা কর্তব্য। ইফতার করতে অকারণ বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। যদি কেউ এ বিলম্বকে অধিক সওয়াব পাওয়ার উপায় কিংবা অধিক তাকওয়া দেখাবার শামিল মনে করেন, তা আদৌ সঠিক নয়। ইফতার ত্বরান্বিত করা কেবল রসুল (সা.)-এর পছন্দ নয়, আল্লাহর কাছেও তা অধিকতর প্রিয়। হাদিসে কুদসিরূপে উল্লেখিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমার কাছে ওই ব্যক্তি সর্বাধিক প্রিয় যে শিগগির ইফতার করে।’ হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতকে রমজান মাসে পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করা হয়, যা আগের কোনো উম্মতকে দেওয়া হয়নি। সে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য হলো- (১) রোজাদারের মুখনিঃসৃত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি হতেও উত্তম; (২) যতক্ষণ না ইফতার করে ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকেন; (৩) আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক দিন তাঁর জান্নাতকে সুসজ্জিত করে রাখেন; অতঃপর জান্নাতকে (সম্বোধন করে) বলতে থাকেন: আমার নেক বান্দাদের বৈষয়িক শ্রম, দায়িত্ব ও কষ্ট নির্যাতন শিগগিরই দূর করা হবে। (৪) তারা আমার কাছে শুভ পরিণতি পাবে। (৫) এ মাসে প্রধান দুষ্কৃতকারী শয়তানকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হবে। ইফতারের সময় ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু’ র্অথাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনার জন্য আমি রোজা রেখেছি, আপনার রিজিকের দ্বারা ইফতার করছি’ এই দোয়া পড়া সুন্নাত। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।’

সিয়ামসাধনার ফলে রোজাদারের জীবনযাপন প্রণালি শৃঙ্খলামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যথামুহূর্তে ইফতার করা এবং শেষ রাতে সাহরি খাওয়া সেই শৃঙ্খলা বিধান ও নিয়মতান্ত্রিকতারই অংশ। ইফতার করার আগে ইফতারসামগ্রী সামনে নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করার মধ্যে ধৈর্যশীলতা ও নিয়মনিষ্ঠার পরিচয় নিহিত। সাহরি ও ইফতার উভয়ই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক : সাবেক সচিব, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য