ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়া অনুসরণ করলে তাদের এ দুর্দশা হতো না

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১০:২১:৩০ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
  • ৭১৪ বার পড়া হয়েছে

|| ড. এসএম আবু জাকের ||

দেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হলেও শতভাগ শরিয়াহ পরিপালিত ইসলামী ব্যাংক এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, যদিও বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সংখ্যা ১০। এছাড়া ১১টি প্রথাগত (কনভেনশনাল) ব্যাংকের রয়েছে ইসলামিক উইন্ডো। অর্থাৎ দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪২ শতাংশ ব্যাংক ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িত।

২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ দশমিক ৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ৯১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৫ কোটি। আর মুসলিমদের মধ্যে একটি বড় অংশ আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ অনুসরণের মাধ্যমে সুদভিত্তিক লেনদেন পরিহার করে চলতে চেষ্টা করে। তারা মদ ও শূকরের মাংসের মতো সুদকেও সমান হারাম হিসেবে গণ্য করে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং এড়িয়ে চলে। ফলে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি হয়ে পড়ছে চোখে পড়ার মতো। আমানত সংগ্রহে মার্চ-২০২৪ শেষে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের অবদান ছিল ২৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং বিনিয়োগ (ঋণ) বিতরণে অবদান ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ধর্মীয় মূল্যবোধে ইসলামী ব্যাংকগুলোয় ব্যাংকিং করে। মানুষের এ ধর্মীয় মূল্যবোধকে পুঁজি করে উদ্যোক্তাদের অনৈতিক উপার্জনের ক্ষেত্র সৃষ্টির পাঁয়তারা রুখে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ধর্মের লেবাস লাগিয়ে শতকোটি টাকা অনৈতিক কারসাজিতে বৈধ উপার্জন করার সমূহ সুযোগ এ খাতে রয়েছে। যে কারণে আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের পর ইসলামী ব্যাংক খাতটি সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ইসলামীকরণ করাই ইসলামী ব্যাংক খাতের মূল সংস্কার হিসেবে গণ্য করা উচিত বলে মনে করি।

এটা সর্বজনবিদিত যে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক সুদের লেনদেন করে না। এ ব্যাংকে আমানতের ওপর প্রদেয় পূর্বঘোষিত শর্ত অনুযায়ী আমানতকারী ও ব্যাংকের মধ্যে মুনাফা ভাগাভাগি হয়। বছর শেষে মুনাফা হিসাবায়ন করে আমানতের ভারিত হারে মুনাফা বণ্টিত হয়। চুক্তির শর্ত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন ৬৫:৩৫ অর্থাৎ আমানতকারীরা পাবেন মুনাফার ৬৫ ও ব্যাংক পাবে ৩৫ শতাংশ। মুনাফা বণ্টনে শরিয়াহর কোনো বিচ্যুতি হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে শরিয়াহ বোর্ড আছে। এ বোর্ড যদি শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত না করে, হিসাবের মারপ্যাঁচে আমানতকারীদের মুনাফা কম দিয়ে পরিচালকদের পকেট ভারী করার সুযোগ থাকে। আমানতকারীদের কত মুনাফা দেয়া হলো তা তো মিডিয়ায় আসে না, কিন্তু বছর শেষে কত হারে ডিভিডেন্ড দেয়া হলো তা পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। অথচ ব্যাংক চলে আমানতকারীদের অর্থে। কিন্তু আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষার চেয়ে ডিভিডেন্ড আহরণকারীদের স্বার্থরক্ষার্থে ব্যাংকগুলো বেশি তৎপর থাকে। এ পদ্ধতির আমূল সংস্কার করে ইসলামী ব্যাংকের ইসলামীকরণ জরুরি। উদাহরণ দেয়া যাক: একটি ইসলামী ব্যাংক ‘পাঁচ বছরে দ্বিগুণ স্কিম’ চালু করে। পাঁচ বছর পর গ্রাহক তার স্কিম ভাঙাতে গেলে যদি বলা হয় ব্যাংক মুনাফা কম করতে পারায় অর্থ দ্বিগুণ পাওয়া যাবে না। গ্রাহক যতই ক্ষোভ প্রকাশ করুক না কেন শরিয়াহর দোহাই দিয়ে গ্রাহককে বোঝানো হয় যে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার নির্দিষ্ট নয়। তাহলে গ্রাহকদের কেন বলা হয় দ্বিগুণ স্কিম! এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। হিসাব খোলার ফরমে হয়তো ব্যাংকের ওই যুক্তির পক্ষে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়া আছে, তা ক’জন গ্রাহকই-বা পড়ে সই করে!

ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনায় বেশি ইসলামীকরণ প্রয়োজন। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও ইসলামী ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরিয়াহর নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে সুদভিত্তিক ব্যাংকের মতো ঋণ/বিনিয়োগ নিয়মাচার প্রতিষ্ঠা করে। শরিয়াহ পরিপালন না হলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয় এবং তা খেলাপিও হয়। উদাহরণ দেয়া যাক: ইসলামী ব্যাংক ঋণ/বিনিয়োগ প্রদান করে কোনো পণ্য ক্রয় করার জন্য। বাই-মোয়াজ্জেল এক ধরনের বিনিয়োগ পন্থা। পণ্য ক্রয়ের জন্য বিক্রেতাকে পে-অর্ডার মূলে পণ্যের মূল্য বুঝিয়ে দিয়ে পণ্যের দখল এক মুহূর্তের জন্য হলেও ব্যাংকের দখলে এনে নির্ধারিত মুনাফা সমেত বিক্রয়মূল্য সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ব্যাংকে ফেরত দেয়ার শর্তে বিক্রির নামই হচ্ছে বাই-মোয়াজ্জেল। বাস্তবে পণ্যের প্রকৃত উপস্থিতি ব্যতিরেকেই অনেক ক্ষেত্রে বাই-মোয়াজ্জেল বিনিয়োগ প্রদান করা হয়। পণ্যবিহীন লেনদেন মানে শরিয়াহ বিবর্জিত লেনদেন। আর এসব লেনদেন সাধারণত রাঘব-বোয়ালদের হিসাবে ঘটে থাকে এবং তা ব্যাংকের জন্য হয়ে যায় বিষফোঁড়া, যার যন্ত্রণায় ব্যাংক ধুঁকতে থাকে বছরের পর বছর। ওইসব বিনিয়োগে যথেষ্ট পরিমাণ কোলেটারাল সিকিউরিটি না থাকায় ব্যাংক গ্রাহকের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারে না খেলাপি হওয়ার ভয়ে। কারণ বড় বিনিয়োগ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকের রেটিং কমে যায়, মুনাফা কমে যায়, স্টক মার্কেটে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, আমানতকারীদের মাঝে আস্থার সংকট দেখা দেয়। এ ধরনের ফাঁদে ব্যাংক একবার যদি পা দেয়, সে ফাঁদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হয় না—প্রতি বছর শরিয়াহ বিবর্জিত পন্থায় ওই বিনিয়োগ নবায়ন করতে ব্যাংক বাধ্য হয়।

আরেকটি বিনিয়োগ পন্থার নাম মুরাবাহা ট্রাস্ট রিসিট। এ পন্থায় গ্রাহক পণ্য আমদানি করে ওই পণ্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করার জন্য ব্যাংক থেকে আমদানি দলিলাদি মূল্য পরিশোধ ছাড়াই পেয়ে যায়। গ্রাহক হয়তো পণ্য ফরওয়ার্ড সেল করে দিয়েছেন, কিন্তু পণ্যমূল্য গ্রাহকের হাতে এলেও তা সময়মতো ব্যাংকে ফেরত আসে না। ফান্ড ডাইভার্ট করে এক্ষেত্রে গ্রাহক অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করার সুযোগ পায়। এভাবে এক ব্যাংকের ঋণ দিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করে ঋণ নিয়মিত রাখে কিন্তু ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। এভাবে একসময় গ্রাহক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এ ধরনের বিনিয়োগে ব্যাংক যেহেতু জামানত বা সিকিউরিটি রাখে না, তাই ব্যাংক কঠোর কোনো অ্যাকশনে যেতে পারে না। অথচ আমদানি গ্রাহকদের সহায়তার জন্য শরিয়াহ বিনিয়োগের উপযুক্ত পন্থা হলো মুরাবাহা পোস্ট ইমপোর্ট বিনিয়োগ। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকের কাছে প্রকৃত আমদানি দলিল ছাড় করার জন্য গ্রাহকের কাছে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে, ব্যাংক গ্রাহকের নামে বিনিয়োগ সৃষ্টি করে নিজ দায়িত্বে পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করে নেয় এবং তা ব্যাংকের গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গ্রাহকের সুবিধামতো সময়ে আংশিক পণ্যমূল্য পরিশোধ করে সমপরিমাণ পণ্য ব্যাংকের গুদাম থেকে ডিওর মাধ্যমে ছাড় করিয়ে নিতে পারে। এ কাজটি ব্যাংকারদের জন্য কষ্টের কাজ হলেও শতভাগ শরিয়াহ পরিপালনে সহায়ক। কিন্তু অজানা কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় কম। আর তাই অসৎ গ্রাহকরা সুযোগ পায় ব্যাংকের ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধ না করতে। অথচ শরিয়াহ এ ধরনের বিনিয়োগকে বেশি উৎসাহিত করে। যেহেতু পণ্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই এ ধরনের বিনিয়োগ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। প্রকৃত শরিয়াহ পরিপালন করে এ ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থায়ন করার জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ইসলামীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই।

ডিল দিয়ে ডিল সমন্বয় করার কোনো বিধান শরিয়াহ অনুমোদন করে না। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলো এ কাজটি করতে বাধ্য হয়। অতীতের রি-ডিলগুলোকে একপাশে রেখে ভবিষ্যতে যেসব ডিল হবে তা যেন রি-ডিল করতে না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। রি-ডিল মানে গ্রাহকের পকেটের টাকা ব্যাংকে জমা না করেই ডিলটাকে এক বছরের জন্য নবায়ন করে ফেলা। অথচ পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রথমে যে ডিলটা দেয়া হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রি করে ওই ডিল সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল। রি-ডিল সুবিধা পেলে পণ্য বিক্রির ওই টাকা গ্রাহক ব্যাংকে জমা না করে ঋণ নবায়নে সুযোগ পায়, যা শরিয়াহ বিবর্জিত পন্থা। ইসলামীকরণের কাজটাকে যদি শক্ত হাতে করা যায়, তাহলে গ্রাহক কখনো রি-ডিল চাইবে না, ব্যাংকও রি-ডিল না দিয়ে ওই ডিলের অর্থ আদায়ের জন্য সচেষ্ট থাকবে।

এছাড়া শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের অন্যতম বিশুদ্ধ বিনিয়োগ পদ্ধতি হলো মুদারাবা এবং মুশারাকা বিনিয়োগ। এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগে ব্যাংকের সম্পৃক্ততা বেশি। অথচ এ বিশুদ্ধ শরিয়াহ বিনিয়োগে এ দেশের কোনো ব্যাংকই আগ্রহ দেখায় না। ব্যাংকগুলো শতভাগ ইসলামীকরণ না হওয়ায় এ বিনিয়োগের পথে প্রধান বাধা বলে প্রতীয়মান হয়।

মোদ্দা কথা বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং যদি সত্যিকার অর্থে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত হতো, তাহলে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ দুর্দশা হতো না। তবে প্রকৃত শরিয়াহ পালন করে যে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব তা বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রমাণিত সত্য। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কথা বাদই দিলাম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ইত্যাদি পাশ্চাত্যের ব্যাংকগুলো ইসলামী উইন্ডোতে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে তো কোনো সমস্যায় পড়েনি, কারণ তারা প্রকৃত শরিয়াহ পালন করেই ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে।

আগস্ট বিপ্লবের পর যেসব ব্যাংক তারল্য সংকট কিংবা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোই বেশি। আর দুর্জনরা এ সুযোগে বলে বেড়াচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং এ দেশে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অথচ পণ্যভিত্তিক বিনিয়োগ তথা শরিয়াহ পরিপালন করে ইসলামী ব্যাংকগুলো যদি অর্থায়ন করত, তাহলে এ সময়ে তাদের ওইরূপ দুর্নামের মালা পরতে হতো না। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এবং শরিয়াহ বোর্ডে ইসলামী ব্যাংকিং তথা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানসম্পন্ন লোক আছে কিনা তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। শরিয়াহ ব্যাংকিং আইন এত বছরেও আমরা করতে না পারায় দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিয়েছে ব্যাংক লুট করতে এবং ঋণের অর্থ ফেরত না দিতে। মাছ ভাগ করার জন্য বিড়ালকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকা কি বোকার স্বর্গে বসবাস করা নয়!

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সংকোচন নয়, বরং পরিবর্ধন করে দেশের ১৬ কোটি মুসলমানের প্রাণের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ইসলামীকরণ করা এখন সময়ে দাবি এবং তা-ই হবে ইসলামী ব্যাংকের মূল সংস্কার।

ড. এসএম আবু জাকের: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহসভাপতি। একটি বেসরকারি ব্যাংকের এডিএমডি

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়া অনুসরণ করলে তাদের এ দুর্দশা হতো না

আপডেট সময় : ১০:২১:৩০ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

|| ড. এসএম আবু জাকের ||

দেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হলেও শতভাগ শরিয়াহ পরিপালিত ইসলামী ব্যাংক এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, যদিও বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সংখ্যা ১০। এছাড়া ১১টি প্রথাগত (কনভেনশনাল) ব্যাংকের রয়েছে ইসলামিক উইন্ডো। অর্থাৎ দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪২ শতাংশ ব্যাংক ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িত।

২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ দশমিক ৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ৯১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৫ কোটি। আর মুসলিমদের মধ্যে একটি বড় অংশ আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ অনুসরণের মাধ্যমে সুদভিত্তিক লেনদেন পরিহার করে চলতে চেষ্টা করে। তারা মদ ও শূকরের মাংসের মতো সুদকেও সমান হারাম হিসেবে গণ্য করে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং এড়িয়ে চলে। ফলে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি হয়ে পড়ছে চোখে পড়ার মতো। আমানত সংগ্রহে মার্চ-২০২৪ শেষে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের অবদান ছিল ২৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং বিনিয়োগ (ঋণ) বিতরণে অবদান ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ধর্মীয় মূল্যবোধে ইসলামী ব্যাংকগুলোয় ব্যাংকিং করে। মানুষের এ ধর্মীয় মূল্যবোধকে পুঁজি করে উদ্যোক্তাদের অনৈতিক উপার্জনের ক্ষেত্র সৃষ্টির পাঁয়তারা রুখে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ধর্মের লেবাস লাগিয়ে শতকোটি টাকা অনৈতিক কারসাজিতে বৈধ উপার্জন করার সমূহ সুযোগ এ খাতে রয়েছে। যে কারণে আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের পর ইসলামী ব্যাংক খাতটি সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ইসলামীকরণ করাই ইসলামী ব্যাংক খাতের মূল সংস্কার হিসেবে গণ্য করা উচিত বলে মনে করি।

এটা সর্বজনবিদিত যে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক সুদের লেনদেন করে না। এ ব্যাংকে আমানতের ওপর প্রদেয় পূর্বঘোষিত শর্ত অনুযায়ী আমানতকারী ও ব্যাংকের মধ্যে মুনাফা ভাগাভাগি হয়। বছর শেষে মুনাফা হিসাবায়ন করে আমানতের ভারিত হারে মুনাফা বণ্টিত হয়। চুক্তির শর্ত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন ৬৫:৩৫ অর্থাৎ আমানতকারীরা পাবেন মুনাফার ৬৫ ও ব্যাংক পাবে ৩৫ শতাংশ। মুনাফা বণ্টনে শরিয়াহর কোনো বিচ্যুতি হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে শরিয়াহ বোর্ড আছে। এ বোর্ড যদি শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত না করে, হিসাবের মারপ্যাঁচে আমানতকারীদের মুনাফা কম দিয়ে পরিচালকদের পকেট ভারী করার সুযোগ থাকে। আমানতকারীদের কত মুনাফা দেয়া হলো তা তো মিডিয়ায় আসে না, কিন্তু বছর শেষে কত হারে ডিভিডেন্ড দেয়া হলো তা পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। অথচ ব্যাংক চলে আমানতকারীদের অর্থে। কিন্তু আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষার চেয়ে ডিভিডেন্ড আহরণকারীদের স্বার্থরক্ষার্থে ব্যাংকগুলো বেশি তৎপর থাকে। এ পদ্ধতির আমূল সংস্কার করে ইসলামী ব্যাংকের ইসলামীকরণ জরুরি। উদাহরণ দেয়া যাক: একটি ইসলামী ব্যাংক ‘পাঁচ বছরে দ্বিগুণ স্কিম’ চালু করে। পাঁচ বছর পর গ্রাহক তার স্কিম ভাঙাতে গেলে যদি বলা হয় ব্যাংক মুনাফা কম করতে পারায় অর্থ দ্বিগুণ পাওয়া যাবে না। গ্রাহক যতই ক্ষোভ প্রকাশ করুক না কেন শরিয়াহর দোহাই দিয়ে গ্রাহককে বোঝানো হয় যে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার নির্দিষ্ট নয়। তাহলে গ্রাহকদের কেন বলা হয় দ্বিগুণ স্কিম! এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। হিসাব খোলার ফরমে হয়তো ব্যাংকের ওই যুক্তির পক্ষে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়া আছে, তা ক’জন গ্রাহকই-বা পড়ে সই করে!

ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনায় বেশি ইসলামীকরণ প্রয়োজন। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও ইসলামী ব্যাংকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরিয়াহর নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে সুদভিত্তিক ব্যাংকের মতো ঋণ/বিনিয়োগ নিয়মাচার প্রতিষ্ঠা করে। শরিয়াহ পরিপালন না হলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয় এবং তা খেলাপিও হয়। উদাহরণ দেয়া যাক: ইসলামী ব্যাংক ঋণ/বিনিয়োগ প্রদান করে কোনো পণ্য ক্রয় করার জন্য। বাই-মোয়াজ্জেল এক ধরনের বিনিয়োগ পন্থা। পণ্য ক্রয়ের জন্য বিক্রেতাকে পে-অর্ডার মূলে পণ্যের মূল্য বুঝিয়ে দিয়ে পণ্যের দখল এক মুহূর্তের জন্য হলেও ব্যাংকের দখলে এনে নির্ধারিত মুনাফা সমেত বিক্রয়মূল্য সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ব্যাংকে ফেরত দেয়ার শর্তে বিক্রির নামই হচ্ছে বাই-মোয়াজ্জেল। বাস্তবে পণ্যের প্রকৃত উপস্থিতি ব্যতিরেকেই অনেক ক্ষেত্রে বাই-মোয়াজ্জেল বিনিয়োগ প্রদান করা হয়। পণ্যবিহীন লেনদেন মানে শরিয়াহ বিবর্জিত লেনদেন। আর এসব লেনদেন সাধারণত রাঘব-বোয়ালদের হিসাবে ঘটে থাকে এবং তা ব্যাংকের জন্য হয়ে যায় বিষফোঁড়া, যার যন্ত্রণায় ব্যাংক ধুঁকতে থাকে বছরের পর বছর। ওইসব বিনিয়োগে যথেষ্ট পরিমাণ কোলেটারাল সিকিউরিটি না থাকায় ব্যাংক গ্রাহকের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারে না খেলাপি হওয়ার ভয়ে। কারণ বড় বিনিয়োগ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকের রেটিং কমে যায়, মুনাফা কমে যায়, স্টক মার্কেটে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, আমানতকারীদের মাঝে আস্থার সংকট দেখা দেয়। এ ধরনের ফাঁদে ব্যাংক একবার যদি পা দেয়, সে ফাঁদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হয় না—প্রতি বছর শরিয়াহ বিবর্জিত পন্থায় ওই বিনিয়োগ নবায়ন করতে ব্যাংক বাধ্য হয়।

আরেকটি বিনিয়োগ পন্থার নাম মুরাবাহা ট্রাস্ট রিসিট। এ পন্থায় গ্রাহক পণ্য আমদানি করে ওই পণ্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করার জন্য ব্যাংক থেকে আমদানি দলিলাদি মূল্য পরিশোধ ছাড়াই পেয়ে যায়। গ্রাহক হয়তো পণ্য ফরওয়ার্ড সেল করে দিয়েছেন, কিন্তু পণ্যমূল্য গ্রাহকের হাতে এলেও তা সময়মতো ব্যাংকে ফেরত আসে না। ফান্ড ডাইভার্ট করে এক্ষেত্রে গ্রাহক অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করার সুযোগ পায়। এভাবে এক ব্যাংকের ঋণ দিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করে ঋণ নিয়মিত রাখে কিন্তু ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। এভাবে একসময় গ্রাহক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এ ধরনের বিনিয়োগে ব্যাংক যেহেতু জামানত বা সিকিউরিটি রাখে না, তাই ব্যাংক কঠোর কোনো অ্যাকশনে যেতে পারে না। অথচ আমদানি গ্রাহকদের সহায়তার জন্য শরিয়াহ বিনিয়োগের উপযুক্ত পন্থা হলো মুরাবাহা পোস্ট ইমপোর্ট বিনিয়োগ। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকের কাছে প্রকৃত আমদানি দলিল ছাড় করার জন্য গ্রাহকের কাছে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে, ব্যাংক গ্রাহকের নামে বিনিয়োগ সৃষ্টি করে নিজ দায়িত্বে পণ্য বন্দর থেকে ছাড় করে নেয় এবং তা ব্যাংকের গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গ্রাহকের সুবিধামতো সময়ে আংশিক পণ্যমূল্য পরিশোধ করে সমপরিমাণ পণ্য ব্যাংকের গুদাম থেকে ডিওর মাধ্যমে ছাড় করিয়ে নিতে পারে। এ কাজটি ব্যাংকারদের জন্য কষ্টের কাজ হলেও শতভাগ শরিয়াহ পরিপালনে সহায়ক। কিন্তু অজানা কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় কম। আর তাই অসৎ গ্রাহকরা সুযোগ পায় ব্যাংকের ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধ না করতে। অথচ শরিয়াহ এ ধরনের বিনিয়োগকে বেশি উৎসাহিত করে। যেহেতু পণ্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই এ ধরনের বিনিয়োগ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। প্রকৃত শরিয়াহ পরিপালন করে এ ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থায়ন করার জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ইসলামীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই।

ডিল দিয়ে ডিল সমন্বয় করার কোনো বিধান শরিয়াহ অনুমোদন করে না। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলো এ কাজটি করতে বাধ্য হয়। অতীতের রি-ডিলগুলোকে একপাশে রেখে ভবিষ্যতে যেসব ডিল হবে তা যেন রি-ডিল করতে না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। রি-ডিল মানে গ্রাহকের পকেটের টাকা ব্যাংকে জমা না করেই ডিলটাকে এক বছরের জন্য নবায়ন করে ফেলা। অথচ পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রথমে যে ডিলটা দেয়া হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রি করে ওই ডিল সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল। রি-ডিল সুবিধা পেলে পণ্য বিক্রির ওই টাকা গ্রাহক ব্যাংকে জমা না করে ঋণ নবায়নে সুযোগ পায়, যা শরিয়াহ বিবর্জিত পন্থা। ইসলামীকরণের কাজটাকে যদি শক্ত হাতে করা যায়, তাহলে গ্রাহক কখনো রি-ডিল চাইবে না, ব্যাংকও রি-ডিল না দিয়ে ওই ডিলের অর্থ আদায়ের জন্য সচেষ্ট থাকবে।

এছাড়া শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের অন্যতম বিশুদ্ধ বিনিয়োগ পদ্ধতি হলো মুদারাবা এবং মুশারাকা বিনিয়োগ। এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগে ব্যাংকের সম্পৃক্ততা বেশি। অথচ এ বিশুদ্ধ শরিয়াহ বিনিয়োগে এ দেশের কোনো ব্যাংকই আগ্রহ দেখায় না। ব্যাংকগুলো শতভাগ ইসলামীকরণ না হওয়ায় এ বিনিয়োগের পথে প্রধান বাধা বলে প্রতীয়মান হয়।

মোদ্দা কথা বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং যদি সত্যিকার অর্থে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত হতো, তাহলে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ দুর্দশা হতো না। তবে প্রকৃত শরিয়াহ পালন করে যে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব তা বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রমাণিত সত্য। মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কথা বাদই দিলাম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি ইত্যাদি পাশ্চাত্যের ব্যাংকগুলো ইসলামী উইন্ডোতে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে তো কোনো সমস্যায় পড়েনি, কারণ তারা প্রকৃত শরিয়াহ পালন করেই ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে।

আগস্ট বিপ্লবের পর যেসব ব্যাংক তারল্য সংকট কিংবা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোই বেশি। আর দুর্জনরা এ সুযোগে বলে বেড়াচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং এ দেশে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অথচ পণ্যভিত্তিক বিনিয়োগ তথা শরিয়াহ পরিপালন করে ইসলামী ব্যাংকগুলো যদি অর্থায়ন করত, তাহলে এ সময়ে তাদের ওইরূপ দুর্নামের মালা পরতে হতো না। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এবং শরিয়াহ বোর্ডে ইসলামী ব্যাংকিং তথা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানসম্পন্ন লোক আছে কিনা তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। শরিয়াহ ব্যাংকিং আইন এত বছরেও আমরা করতে না পারায় দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিয়েছে ব্যাংক লুট করতে এবং ঋণের অর্থ ফেরত না দিতে। মাছ ভাগ করার জন্য বিড়ালকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকা কি বোকার স্বর্গে বসবাস করা নয়!

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সংকোচন নয়, বরং পরিবর্ধন করে দেশের ১৬ কোটি মুসলমানের প্রাণের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ইসলামীকরণ করা এখন সময়ে দাবি এবং তা-ই হবে ইসলামী ব্যাংকের মূল সংস্কার।

ড. এসএম আবু জাকের: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহসভাপতি। একটি বেসরকারি ব্যাংকের এডিএমডি