নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বের ইতিহাসে আরবদের সাহিত্যামোদিতা সর্বজন বিদিত। আরব শব্দের অর্থের মধ্যেই বাগ্মিতা ও বাকপটুতার ইঙ্গিত আছে।
বলা হয়ে থাকে, আরবি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। এ ভাষায় সাহিত্যরস, সাহিত্যসম্ভার ও সাহিত্যের উপাদান অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে কম নয়। তাই আরবি ভাষা বাদ দিয়ে যেমন পৃথিবীর ভাষার ইতিহাস হতে পারে না, একইভাবে আরবি সাহিত্য বাদ দিয়ে বিশ্বসাহিত্য হতে পারে না। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসও আরবি সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া রচিত হতে পারে না।
এটা সত্য যে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার সাহিত্যচর্চা কাব্য দিয়েই শুরু হয়েছিল। আরবি ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। কবিতাই ছিল প্রাচীন আরবদের আত্মার খোরাক। প্রাক-ইসলামী যুগে লিখন প্রণালী তেমন উন্নত ছিল না। তাই আরবরা তাদের রচনার বিষয়বস্তু মুখস্থ করে রাখত। তাদের স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। তারা মুখে মুখে কবিতা পাঠ করে শোনাত। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্যের প্রতিভা প্রকাশ পেত। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক নিকলসন লিখেছেন : ‘ওই যুগে কবিতা কিছুসংখ্যক সংস্কৃতিমনা লোকের বিলাসিতার বস্তু ছিল না; বরং এটা ছিল তাদের সাহিত্যানুরাগ প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। এ কারণে লোকগাথা, প্রবাদ, জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী সময়ে আরব জাতির ইতিহাস লেখা হয়েছে। ’
পি কে হিট্টি লিখেছেন : ‘কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। ওই যুগে আরবদের মধ্যে যে সাহিত্যচর্চা প্রচলিত ছিল, উকাজের মেলা এর একটি উত্কৃষ্ট প্রমাণ। প্রতিবছর এ মেলায় কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ’ কথিত আছে, উকাজের মেলায় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাতটি কবিতাকে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে কাবাগৃহের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এ ঝুলন্ত সাতটি গীতিকবিতাকে আরবিতে ‘সাবউ মু’আল্লাকাত’ বলা হয়। আজও আরবি ভাষাভাষী বিশ্বে কবিতাগ্রন্থ হিসেবে ‘সাবউ মু’আল্লাকাত’ বিশেষ সম্মানের আসনে সমাসীন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বাংলা ভাষাভাষী পাঠকরা এত দিন এমন গৌরবময় সাহিত্যের রস ও রসায়ন থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে আনন্দ ও আশার বিষয় হলো, এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও আরবি বিভাগের সাবেক সফলতম চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী। ২০১০ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জাহিলি যুগের কাব্যে মানবতাবোধ’ শীর্ষক বিষয়ের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি অত্যন্ত সিদ্ধহস্তে প্রাচীন আরবি কবিতাগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বলা যায়, বইটি বাংলা ভাষায় প্রাচীন আরবি কবিতার অনুবাদসমগ্র।
এ বইটি কেন তিনি লিখেছেন—এ বিষয়ে আলোচ্য গ্রন্থের শুরুতে বলা হয়েছে : ‘‘আরবি সাহিত্যের উচ্চশিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের আদলে এই গ্রন্থটি প্রণীত হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার বিএ অনার্স ও মাস্টার্সের পাঠ্যতালিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে প্রাচীন আরবি কবিতা। ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এতে আরবি সাহিত্যের প্রাচীন পর্বসমূহের তথা জাহিলি, ইসলামী (মুখাদরাম), উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগের খ্যাতিমান কবিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বশীল ও বিখ্যাত কবিতাগুলো সংকলন করে এর অনুবাদ করা হয়েছে। সব শেষে আবু তাম্মাম সংকলিত ‘দীওয়ানুল হামাসা’রও অনুবাদ সংযোজিত হয়েছে।
নির্বাচিত কবিতা অনুবাদের পাশাপাশি প্রত্যেক কবির জীবনালেখ্য ও কাব্যপ্রতিভার মূল্যায়নধর্মী আলোচনা করে উপস্থাপিত কবিতার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে এতে; যাতে একজন পাঠক কবি ও কবিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারেন। এটি প্রাচীন আরবি কবিতার সংকলন হলেও শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এতে আরবি সাহিত্যের ইতিহাস, যুগ মানস ও যুগ-প্রভাব সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। ”