মঙ্গলবার | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | শীতকাল
শিরোনাম :
Logo নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রেস সচিবের Logo মহান বিজয় দিবস আগামীকাল Logo নোবিপ্রবি ছাত্রশিবির আয়োজিত আন্তঃবিভাগ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত Logo জামায়াতের নির্বাচনী সভায় পুলিশ সদস্যের অংশগ্রহণ, এএসআইয়ের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা Logo মিজাফ বিজয় সম্মাননা পেলেন চিত্রনায়ক ডি এ তায়েব Logo সমাজসেবায় ৯ বছরের পথচলা: জীবনদীপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোচনা সভা Logo চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়া ব্র্যাকের উদ্যোগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ক্লিনিং ক্যাম্পেইন Logo ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ভান্ডার ‘বনফুল’ চাঁদপুর শাখা উদ্বোধন Logo প্রাইভেট হাসপিটাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক এসোসিয়েশন চাঁদপুর জেলা শাখার কমিটি গঠন সভাপতি ডাঃ মোবারক হোসেন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক জি এম শাহীন Logo কচুয়ায় বিশেষ অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত মাদক মামলার পলাতক আসামি গ্রেফতার

মব সন্ত্রাস নিয়ে সমাজের আতঙ্ক ও রাষ্ট্রের নীরবতা

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:৩১:৪২ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
  • ৮৬২ বার পড়া হয়েছে

||আহমেদ স্বপন মাহমুদ ||

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ক্রমবর্ধমান মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাসের ঘটনা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অকার্যকর সুশাসন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা আইনহীন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী। বিগত আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই যেন ধারাবাহিকতা এই মব সন্ত্রাস। 

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ক্রমবর্ধমান মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাসের ঘটনা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অকার্যকর সুশাসন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা আইনহীন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী। বিগত আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই যেন ধারাবাহিকতা এই মব সন্ত্রাস।

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ঢাকায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার ঘটনাও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়।

এসব ঘটনার পেছনে শুধু জনরোষ নয়; আছে সংগঠিত উস্কানি ও উদ্দেশ্যমূলক সহিংসতা। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজেরাই মব সন্ত্রাসকে কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে বসেন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ‘মব’কে বলেছেন ‘প্রেশার গ্রুপ’, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মবের কর্মকাণ্ডকে ‘জনতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

এসব বক্তব্য শুধু দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে না, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক সহিংসতাকে অনুমোদন দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়– যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগজনক। মবের ‘ন্যায়বিচার’ যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের প্রয়োজনই-বা থাকে কোথায়?

সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো। অসংগত, অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে গণআক্রমণের যে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, তা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নয়; গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় হুমকি।

আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হুমকি দেওয়া। নাটক-সিনেমা-গান-নৃত্যকে যারা ‘ইসলামবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বিভিন্ন হলেও কৌশল প্রায় একই। গত ফেব্রুয়ারিতে খুলনার এক নাট্যোৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয় ধর্মীয় সংগঠনের চাপে। একই মাসে মৌলভীবাজারে এক বইমেলায় হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকজন তরুণ লেখকের বই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এই আক্রমণ একটি পরিকল্পিত ‘নীরব দমন নীতি’র অংশ, যেখানে রাষ্ট্র সক্রিয় না হয়ে মৌন সম্মতি জানিয়ে যাচ্ছে।

নারীর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, নারীকে অসম্মান করার প্রবণতাও বাড়ছে। তা ছাড়া নারী ক্রীড়াবিদদের ওপর হামলা আরও বেশি প্রকাশ্য ও হিংস্র হয়েছে। লেখক, সাংবাদিক ও ব্লগারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আজ সংকটের মুখোমুখি। লেখক, অনুবাদক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নানা হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন ঘটনা ঘটার পর আসে, কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয় না, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা অচল পড়ে থাকে। এমনকি মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘ধর্মীয় আবেগে উত্তেজিত হয়ে কিছু লোক এ কাজ করেছে।’ এটি আসলে অপরাধকে আড়াল করা এবং ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় সহিংসতার জায়গা তৈরি করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিকে অপরাধীদের উৎসাহিত করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে করে নিরুপায় ও আতঙ্কিত।

এই প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে, সরকার কি নিজেই এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আছে? নাকি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে, যেমন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে, এই নীরবতা বজায় রাখছে?

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে নারী অধিকারের প্রশ্নে এই সহিংসতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশে সামাজিক সহনশীলতা হ্রাস ও ‘পাবলিক ফিয়ার’ বৃদ্ধির তথ্য এসেছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও জন্য হুমকি।

এই সংকট মোকাবিলায় নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সংস্কৃতিকর্মী, নারী সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মব সন্ত্রাস, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা মিলে বাংলাদেশ এক নীরব দুর্যোগের দিকে এগোচ্ছে। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, আগামীকাল আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভয়ংকর সমাজ রেখে যাব– যেখানে মতপ্রকাশ নেই, নারীর স্বাধীনতা নেই, সংস্কৃতির চর্চা নেই। রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের দায়িত্ব সেই শূন্যতা পূরণ করা। কথা বলতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। কারণ নীরবতা মানেই সম্মতি, আর সম্মতি মানেই সহিংসতার অংশীদার হওয়া। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী 

সূত্র ঃ সমকাল
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রেস সচিবের

মব সন্ত্রাস নিয়ে সমাজের আতঙ্ক ও রাষ্ট্রের নীরবতা

আপডেট সময় : ১২:৩১:৪২ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

||আহমেদ স্বপন মাহমুদ ||

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ক্রমবর্ধমান মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাসের ঘটনা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অকার্যকর সুশাসন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা আইনহীন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী। বিগত আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই যেন ধারাবাহিকতা এই মব সন্ত্রাস। 

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে গত প্রায় এক বছরে ক্রমবর্ধমান মব ভায়োলেন্স বা মব সন্ত্রাসের ঘটনা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, অকার্যকর সুশাসন এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা আইনহীন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী। বিগত আমলের বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই যেন ধারাবাহিকতা এই মব সন্ত্রাস।

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ঢাকায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার ঘটনাও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়।

এসব ঘটনার পেছনে শুধু জনরোষ নয়; আছে সংগঠিত উস্কানি ও উদ্দেশ্যমূলক সহিংসতা। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজেরাই মব সন্ত্রাসকে কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে বসেন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ‘মব’কে বলেছেন ‘প্রেশার গ্রুপ’, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মবের কর্মকাণ্ডকে ‘জনতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

এসব বক্তব্য শুধু দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে না, বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক সহিংসতাকে অনুমোদন দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়– যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগজনক। মবের ‘ন্যায়বিচার’ যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসনের প্রয়োজনই-বা থাকে কোথায়?

সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো। অসংগত, অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে গণআক্রমণের যে সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, তা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নয়; গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক বড় হুমকি।

আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হুমকি দেওয়া। নাটক-সিনেমা-গান-নৃত্যকে যারা ‘ইসলামবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বিভিন্ন হলেও কৌশল প্রায় একই। গত ফেব্রুয়ারিতে খুলনার এক নাট্যোৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয় ধর্মীয় সংগঠনের চাপে। একই মাসে মৌলভীবাজারে এক বইমেলায় হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকজন তরুণ লেখকের বই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এই আক্রমণ একটি পরিকল্পিত ‘নীরব দমন নীতি’র অংশ, যেখানে রাষ্ট্র সক্রিয় না হয়ে মৌন সম্মতি জানিয়ে যাচ্ছে।

নারীর প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, নারীকে অসম্মান করার প্রবণতাও বাড়ছে। তা ছাড়া নারী ক্রীড়াবিদদের ওপর হামলা আরও বেশি প্রকাশ্য ও হিংস্র হয়েছে। লেখক, সাংবাদিক ও ব্লগারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আজ সংকটের মুখোমুখি। লেখক, অনুবাদক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নানা হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন ঘটনা ঘটার পর আসে, কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয় না, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা অচল পড়ে থাকে। এমনকি মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘ধর্মীয় আবেগে উত্তেজিত হয়ে কিছু লোক এ কাজ করেছে।’ এটি আসলে অপরাধকে আড়াল করা এবং ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় সহিংসতার জায়গা তৈরি করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিকে অপরাধীদের উৎসাহিত করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে করে নিরুপায় ও আতঙ্কিত।

এই প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে, সরকার কি নিজেই এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আছে? নাকি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে, যেমন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে, এই নীরবতা বজায় রাখছে?

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে নারী অধিকারের প্রশ্নে এই সহিংসতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপি সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশে সামাজিক সহনশীলতা হ্রাস ও ‘পাবলিক ফিয়ার’ বৃদ্ধির তথ্য এসেছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও জন্য হুমকি।

এই সংকট মোকাবিলায় নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সংস্কৃতিকর্মী, নারী সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মব সন্ত্রাস, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা মিলে বাংলাদেশ এক নীরব দুর্যোগের দিকে এগোচ্ছে। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, আগামীকাল আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভয়ংকর সমাজ রেখে যাব– যেখানে মতপ্রকাশ নেই, নারীর স্বাধীনতা নেই, সংস্কৃতির চর্চা নেই। রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিকদের দায়িত্ব সেই শূন্যতা পূরণ করা। কথা বলতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। কারণ নীরবতা মানেই সম্মতি, আর সম্মতি মানেই সহিংসতার অংশীদার হওয়া। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী 

সূত্র ঃ সমকাল