গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস কিছুদিন ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রেখে আবার চালু করলেও তা চলছে অত্যন্ত সীমিত আকারে। বর্তমানে কেবল শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসার জন্য ভিসার আবেদন করা যাচ্ছে। ভারতের ভিসা জটিলতার কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতগামী ফ্লাইটের সংখ্যাও কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস ভারতে থাকায় সংকটে পড়ছেন ইউরোপে পড়তে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও চিকিৎসার জন্যেও ভিসা পেতেও হিমশিম খাচ্ছেন আবেদনকারীরা। সীমিত ভিসা দেওয়ার প্রভাব পড়ছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।
ফ্লাইট সংখ্যা কমে অর্ধেক
ভিসা জটিলতার সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে এয়ারলাইন্স ব্যবসায়। বাংলাদেশের তিনটি বিমান সংস্থা নভোএয়ার, ইউএস বাংলা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ভারতে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।
একই অবস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। আগে ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-চেন্নাই ও ঢাকা-দিল্লি রুটে সপ্তাহে ২৮টি ফ্লাইট পরিচালিত হলেও বর্তমানে চলছে মাত্র ১৩টি ফ্লাইট। আর পুরোপুরি বন্ধ আছে কেবল ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী নভোএয়ারের ফ্লাইট।
সংস্থাটির মার্কেটিং এন্ড সেলসের প্রধান মেজবাউল ইসলাম জানান, আগে প্রতিদিন নভোএয়ারের একটি করে ফ্লাইট ঢাকা থেকে কলকাতায় গেলেও যাত্রী কমার পর তা কমিয়ে সপ্তাহে তিনটি করা হয়। তবে ১৬ তারিখ থেকে ফ্লাইট চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে সংস্থাটি।
ভারত চিকিৎসা ভিসা দিলেও চেন্নাইগামী ফ্লাইটের সংখ্যাও ‘আপ টু দ্য মার্ক’ না বলে জানান এই কর্মকর্তা। এছাড়াও ‘৫০ থেকে ৬০ শতাংশ লোড নিয়ে ফ্লাইটগুলো অপারেট করতে হচ্ছে’ বলেও জানান তিনি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম বলেন, “যাত্রী যাওয়ার ফ্লো কমে গেছে। কমার ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক ফ্লাইট আন্ডারলোড যাচ্ছে। তখন আমারা এটা কমিয়ে নিয়ে এসে এডজাস্ট করেছি যে এরকম ফ্রিকোয়েন্সি থাকলে আমাদের মোটামুটি অপারেটিং কস্ট উঠে আসবে।”
ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশি কোনও শিক্ষার্থীকে ইউরোপের দেশগুলোতে পড়তে যেতে হলে, ভারতে গিয়ে সেই দেশের দূতাবাস থেকে দেশটির ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রথমে ভারতের ভিসা প্রয়োজন হয়।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাঁচই আগস্টের দুইদিন পর থেকে ভারতীয় দূতাবাস ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রাখে। প্রায় এক সপ্তাহ পর দেশটি ‘সীমিত আকারে’ ভিসার কাজ চালু করে।
সাধারণত কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণ-সহ ১৫টি ক্যাটাগরিতে ভারত বাংলাদেশকে ভিসা দিয়ে থাকে।
কানিজ রাতুল বলেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আমি প্রতিদিন ট্রাই করেছি। কিন্তু দেখা গেছে তাদের সার্ভার সবসময় ডাউন থাকে, স্লট পাওয়া যায় না।
একদিকে রোমানিয়ান দূতাবাসে যাওয়ার তারিখ এগিয়ে আসা, অন্যদিকে ভারতীয় ভিসা না পাওয়ায় রোমানিয়ায় পড়তে যাওয়ার জন্য অফার লেটার পাওয়া সাড়ে তিনশোর মতো শিক্ষার্থী রোমানিয়ার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন বলে জানান তিনি।
তাদের প্রায় সবারই টিউশন ফি জমা হয়ে গেছে উল্লেখ করে মিজ রাতুল বলেন, আমাদের ভিসা ক্যান্সেল হয়েছে এবং রোমানিয়ার ভিসা আমরা পাইনি সেই কাগজপত্র যদি দেখাতে না পারি, সেটা কিন্তু রিফান্ড হবে না।
সার্বিক পরিস্থিতি জানার পর কাছাকাছি যে দেশগুলোতে রোমানিয়ার দূতাবাস আছে সেখান থেকে অফার লেটার পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভিসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে কেবলমাত্র তারাই ওই দেশগুলোর দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে পারবেন যারা ভারতীয় ভিসা পাননি। বর্তমানে ভিসা নিতে ভিয়েতনামে আছেন কানিজ রাতুল।
অনেকটা একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন রংপুরের বাসিন্দা আফসানা শাহরিন। মাস্টার্স করতে রোমানিয়ায় যেতে আগ্রহী শাহরিনের ভিসার জন্য ১৪ই সেপ্টেম্বর দেশটির দূতাবাসে যেতে হবে। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ভারতীয় ভিসার স্লট পাচ্ছেন না তিনি। সবশেষ ৯ তারিখ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে পাসপোর্ট জমা দেয়ার পর ১৯ তারিখ তা ফেরত পেলেও পাননি ভিসা।
শাহরিন বলেন, আমি এখনও চেষ্টা করছি। আজকেও এতক্ষণ করে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। এটাতো আমরা যারা বাইরে পড়তে যাব তাদের জন্য ঝামেলা।
রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে পড়তে যেতে আগ্রহী সব শিক্ষার্থীরই এই সমস্যা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলাম। আমাদের বলেছিল কাজ হবে, কিন্তু হয় নাই। আমরা যে কী করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না!
চারশোর বেশি বাংলাদেশি ভিসা রিভিউ
ভারত থেকে বাংলাদেশিদের যে সীমিত সংখ্যক ভিসা দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে ভারত সরকার।
ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত একটি খবর বলছে, নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে করা আবেদনের মধ্যেও শুধু অগাস্টেই ৪৩৪টি বাংলাদেশি ভিসা রিভিউ করেছে ভারত।
পিআরসি বা প্রায়োর রেফারেল চেকের এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত ভিসা দেওয়ার আগে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আবেদনকারীর ব্যাকগ্রাউন্ডের খোঁজ খবর নেয়। একই মাসে পাকিস্তানের ৮৭৮টি ভিসা রিভিউ করা হয়েছে বলে খবরটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রভাব পড়েছে ভারতের স্থানীয় ব্যবসায়
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশটিতে পর্যটন খাতে ভ্রমণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ, যা কিনা সে দেশে মোট বিদেশি পর্যটকের ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
ফলে ভিসা না দেওয়ায় কেবল যে বাংলাদেশিরাই ভোগান্তিতে পড়ছে, তেমনও না।
ভিসা কার্যক্রম সীমিত থাকায় সমস্যায় পড়েছেন ভারতের পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।
রাজেশ আহুজা নামের কলকাতার একজন ব্যবসায়ী বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে যে ঘটনাটা ঘটল, শুরুতে তাতে একটা ধাক্কা লেগেছে। প্রথম কিছুদিন আমরা ক্লিয়ারলি দেখতে পাই, মানুষ আসা কমে যায়। মাস দুয়েক প্রভাব ছিল। কিন্তু পুরনো যাদের ভিসা ছিল তারা ফিরে আসছে।
হোটেল ও ট্যুরিজম ব্যবসায়ী মনোতোষ সরকার বলেন, এখন কিছুটা হলেও আমাদের ভাঁটা পড়েছে। কেন না ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ আছে, যারা মেডিক্যাল ভিসায় আসছে, তারা টুকটাক আসছে।
ট্যুরিস্ট ভিসা না থাকায় ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে বলে জানাচ্ছিলেন মো. কামরুদ্দিন মল্লিক। বলেন, ‘সর্বোচ্চ ২০ পারসেন্ট আসছে এখন, ৮০ পারসেন্ট ট্যুরিস্ট নেই। যারা আসছে তারাও মেডিক্যালের কাজ করে চলে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট ভিসা হলে কেনাকাটা কিছুটা হয়।’
ভিসা না দেওয়ার কারণ কী?
‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ভারত আশ্বস্ত হচ্ছে না বলেই হয়তো’ এখনও ভিসা নিয়ে এমন কড়াকড়ি করছে দেশটি, এমনটাই মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির।
কিন্তু কিন্তু ভিসা না দেওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রভাব তো নেতিবাচক বটেই। ভিসা যদি না দেওয়া হয় তাহলে যাতায়াত কমে যায়। যাতায়াত কমা মানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই নানান জটিলতায় পড়েন। দুই দেশের পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি যেটা ব্যাহত হয় নিশ্চিভাবেই।’
আবার বাংলাদেশিরা দেশটিতে কম যাওয়ায় ভারতের স্থানীয় ব্যবসাও ক্ষতির মুখে পড়ে।
‘কলকাতায় বাংলাদেশি ভিজিটরস না থাকার ফলে ট্যুরিজম বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। কলকাতার বিপণীবিতানগুলোর অবস্থা একটু চাপের মুখে আছে। তাতে করে স্থানীয় অর্থনীতির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এটাতে লাভ কারোই হচ্ছে না। দুই দেশের মানুষ এতে করে এফেক্টেড হয়ে যাচ্ছে’, বলছিলেন মি. কবির।
লাভ না হলেও ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের কঠোরতার কারণ কি কেবলই নিরাপত্তা না এর পেছনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও আছে, উঠছে এমন প্রশ্নও।
তবে এক্ষেত্রে যদি নিরাপত্তার প্রসঙ্গ মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলেই মত এই বিশ্লেষকের।
সূত্র: বিবিসি বাংলা