নিউজ ডেস্ক:
আমার থেকে বয়সে বছর চারেক বড় হবে। কিন্তু আমরা দু’জনই তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। সেই থেকে একসাথে স্কুলে যাওয়া একসাথে ফিরে আসা। কিন্তু বাড়ি এসে রোকেয়া আমার মতো খেলা কিংবা বিশ্রামের সুযোগ পেত না। কেননা, সে ছিল আমাদের ঘরের পরিচারিকা। যাকে সহজেই সবাই কাজের মেয়ে বলে। আমার অল্প শিতিা মায়ের একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল। তিনি চাইতেন মেয়েরা লেখাপড়া করুক। সে নিজের মেয়েই হোক কিংবা কাজের মেয়ে। মায়ের সেই সুপ্ত ইচ্ছার ফলেই রোকেয়াকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মা। এমনকি সন্ধ্যার পর মা নিজে বসে রোকেয়াকে পড়াতেন। পড়া শেষে রোজ রাতে রোকেয়া তার রাতের খাবারটা বাটিতে করে নিয়ে যেত নিজের ঘরে। যেখানে তার জন্য রোজ অপো করত তার একমাত্র ছোট্ট ভাইটি। আমার মা তাই রাতের বেলা রোকেয়াকে একটু বেশিই খাবার দিতেন। যাতে ছোট ভাইকে নিয়ে সে খেতে পারে।
আমার বইয়ের ব্যাগটি রোকেয়াই বহন করত। তবু রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় রোকেয়া ব্যাগটি বহন করার জন্য আমার সাথে কাড়াকাড়ি করত। কোনো দিন দিতাম কোনো দিন দিতাম না। বর্ষাকালে যখন রাস্তায় কাদামাটিতে একাকার হয়ে যেত, রোকেয়া জোর করে আমাকে কোলে নিতে চাইত। যখন ছোট ছিলাম ওর কোলে উঠতাম। যখন একটু বড় হলাম সে নিতে চাইলেও আমি উঠতাম না। রোকেয়া তবু আমাকে সাবধানে পার করে নিয়ে যেত। এভাবে তার স্নেহে আমি কখনোই অসহায়ত্ব অনুভব করিনি।
কিন্তু এক দিন খুব অসহায় অনুভব করলাম। এতটা অসহায় কোনো দিন লাগেনি নিজেকে। তখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন দেখলাম রোকেয়াকে নিয়ে বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেছে। ঘরের পেছনের একটি ছোট্ট পেয়ারাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রোকেয়া অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। ওর কান্না দেখে আমারও চুপ করে থাকা হলো না। কেঁদে ফেললাম। রোকেয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে। সে কোনো জবাব দিলো না। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম মাও নিরুত্তর। রোকেয়ার মাকে মমতাজ খালা বলে ডাকতাম। মমতাজ খালা তখন নিজের কপাল থাপড়াচ্ছে আর বলছে, তোর কেন মরণ হলো না? কেন তুই আমারে এই মুখ দেখালি? তুই এই পাপের মুখ কেন আমারে দেখাইলি? তোরে কাইটা টুকরা টুকরা কইরা নদীতে ভাসাই দিমু। তোর মতো মাইয়ার মুখ দেহনও পাপ।
আমি তখন এসবের কিছুই বুঝিনি। বুঝতে পারি তারও অনেক দিন পরে। অনেক দিন নয়, অনেক বছর পর। যখন বুঝতে শিখেছি পুরুষের হাতে নারী কেমন করে লাঞ্ছিত হয়, যখন বুঝতে শিখেছি একটি মেয়ে কেমন করে ধীরে ধীরে নারী হয়ে ওঠে, নারীর মা হতে কত সময় লাগে। কারো কাছে প্রশ্ন করতে হয়নি। ধীরে ধীরে সবই আমার বোধগম্য হয়ে যায়।
কিন্তু পৃথিবীতে তখন আমার মতো অসহায় আর কেউ ছিল না। রোকেয়ার চোখের পানি আমি মুছে দিতে পারিনি। আর তখন যদি জানতাম কী কারণে রোকেয়ার ওই পরি্িস্থতি হয়েছিল আমি হয়তো লজ্জায় ওর সামনেই যেতে পারতাম না। যখন ধীরে ধীরে জেনেছি রোকেয়ার পাপের কারণ ছিল আমারই পরিবারের কেউ। হোক না সেই কেউ আমার অতি আপনজন। শুধু কি আমারই আপনজন? রোকেয়ার কি আপন ছিলেন না তারা? তবু রোকেয়ার প্রতি কেন সেই আপনজনেরা সেই রকেরা কামনার থাবায় হাত বাড়িয়েছিল? যখন রোকেয়াকে কাঁদতে দেখেছি, যখন রোকেয়ার মাকে কাঁদতে দেখেছি তখন আমিও কেঁদেছি। আমি খুব অসহায় বোধ করেছি। যখন দেখেছি দিনের পর দিন আমার মা নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছেন, রাতের বেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ফুঁপিয়ে উঠতেন তখন আমি বড় অসহায় বোধ করেছি। এখনো রোকেয়ার সামনে যেতে আমার পর্বতসমান লজ্জা। ওর সম্ভ্রম হারানোর জন্য আমিও অপরাধের ভাগিদার।