যে গুণাবলী মানুষের জীবনকে সফল ও সার্থক করে তোলে তন্মধ্যে সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যশীলতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষ গুণটির সামনে অন্যায়-অনাচার মাথানিচু করে।
ফলে সহিষ্ণু ব্যক্তি স্বীয় গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। সহিষ্ণুতা জীবন বিকাশের প্রবল বাধাকে অনুকূলে আনয়ন করে, বিজয়ী ঘোষণা করে সহনশীল মানুষকে।
সহিষ্ণুতা বা সবর বলতে বুঝায় সংযম অবলম্বন ও নফসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ। সহ্য করার বৈশিষ্ট্যের নাম সহিষ্ণুতা। নিজের মনোভাবের সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টি করে না এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষমতা ও ঔদ্বত্য প্রকাশ না করে নম্রতা ও সৌজন্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করাই ধৈর্যশীলতা।
সহিষ্ণুতা গুণসম্পন্ন মানুষ কখনও বিরোধকে প্রবল করে তোলে না। ধৈর্যধারণকারী মানুষ নিজের সমূহ ক্ষতি স্বীকার করে অন্যকে হাসিমুখে মোকাবিলা করে। নিজের শক্তি-সামর্থ থাকলেও যে অপরের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে না তার মধ্যে সহিষ্ণুতা গুণ বিদ্যমান বলে বিবেচনা করা চলে। অপরের ঔদ্ধত্যকে যে ব্যক্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে সে ব্যক্তি যথার্থ ধৈর্যশীল বলে মর্যাদা পায়। এভাবে সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ধৈর্য, ক্ষমা ও মহত্ত্বের পরিচয় মেলে।
পবিত্র কোরআনে কারিম হাদিসের পরিভাষায় সবরের ৩টি শাখা রয়েছে—
এক. নফসকে হারাম এবং নাজায়েজ বিষয়াদী থেকে বিরত থাকা।
দুই. ইবাদত ও আনুগত্যে বাধ্য করা।
এবং তিন. যেকোনো বিপদ ও সংকটে ধৈর্যধারণ করা। অর্থাৎ সে সব বিপদাপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলোকে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা করা।
অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোনো কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায়, কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে তা সবরের পরিপন্থী নয়। -ইবনে কাসির
সবরের উপরোক্ত ৩টি শাখাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কোরআন-হাদিসের পরিভাষায় ধৈর্যধারণকারী বা ‘সাবের’ সে সমস্ত লোককেই বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেরই সবরের অবলম্বন করে।
মানব জীবনে সহিষ্ণুতার প্রয়োজনের শেষ নেই। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সমাজের সকল মানুষ এক রকম নয়। সামাজিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে নানা কারণে বিরোধিতা দেখা দেয়। এই বিরোধ সহজেই প্রবল আকার ধারণ করতে পারে এবং তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এই ধরনের সংকটজনক পরিস্থিতির ক্ষতিকর পরিণাম থেকে অব্যাহতি লাভের দরকার সহিষ্ণুতার মতো সৎ গুণের। সমাজের মধ্যে নানান ধরনের লোক বসবাস করে। সকলের রুচি ও মনমানসিকতা এক রকম নয়। ফলে পারস্পরিক বিরোধ এবং প্রতিহিংসার সৃষ্টি সাধারণ ব্যাপার। এই পরিস্থিতির কল্যাণকর সমাধানের জন্য সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। মানুষের ব্যক্তিজীবনে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। সেখানে অনেক প্রতিপক্ষ থাকে। তাদের কাছে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে মন জয় করা যায়। মতবিরোধ এড়িয়ে সদিচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। সহিষ্ণুতার মহৎ গুণটি এখানে বিশেষ অর্থবহ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক জীবনের মতো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সহনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। পরস্পর বিরোধ এড়িয়ে, প্রতিপক্ষকে শত্রু বলে বিবেচনা না করে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজকর্ম চালিয়ে গেলে সেখানে সহিষ্ণুতার নিদর্শন মেলে। সকল কাজের শুভ পরিণতি আনয়নে সহিষ্ণুতা সাহায্য করে। যোগ্যতা দিয়ে মানুষ সমাজে টিকে থাকে। সে যোগ্যতা প্রদর্শন ও তার ফল হাতে না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করতে হবে। উগ্র প্রতিপক্ষকে শক্তির সাহায্যে পরাভূত করার চেয়ে ধৈর্যধারণ করার মাধ্যমে পরাভূত করা সহজ। জীবনের প্রতিকূল অবস্থায় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে পারলে দুঃখ, কষ্ট ও মনোবেদনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই জীবনে সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
জীবনকে সুন্দর, সার্থক ও মহৎ করার জন্য সহিষ্ণুতার ব্যাপক অনুশীলনতা করা দরকার। এর প্রতিদানে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অনুকূলেই থাকেন। ’ –সূরা বাকারা : ১৫৪
পবিত্র কোরআনে আরো ঘোষণা করা হয়েছে, ‘সবরকারী বান্দাদেরকে তাদের পুরস্কার বিনা হিসেবে প্রদান করা হবে। ’ -সূরা আজ জুমার : ১০
সহিষ্ণু হলে জীবনে যে সাফল্য আসে তার প্রভাব চারপাশের জীবনে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সহিষ্ণুতার পথ অনুসরণ করতে হবে। জীবনকে সুন্দর ও সফলকাম করার যে সাধনায় মানুষ নিজেকে সমর্পণ করেছে তা করার জন্য সহিষ্ণুতাকে উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে জীবন হয়ে উঠবে সার্থক ও সুন্দর।






















































