গত ২৩ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত ১৫ দিনের সফরে বাংলাদেশ এসেছিল আইএমএফের প্রতিনিধি দল। সফলকালে তারা অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে। যে দিন আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঢাকা ত্যাগ করে সে দিনই সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এই সফর নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি ও গৃহিত পদক্ষেপসহ সংস্থাটির বিভিন্ন পরামর্শও তুলে ধরা হয়। সে সময়েই চলতি মাসের ১৮ তারিখ ঘোষণা হতে যাওয়া মুদ্রানীতিতে নীতিসুদ (রেপো) হার বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার ইঙ্গিত মেলে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্রমতে, আগের মুদ্রানীতিগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্যও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। ফলে সুদহার, রেপো এবং রিভার্স রেপোর মতো মুদ্রানীতির মৌলিক বিষয়গুলো আরো বাড়তে পারে। অপরদিকে ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পরও বিনিময় হারে স্থিরাবস্থা না আসায় এবার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ করা হতে পারে বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো। জানা গেছে, গত রবিবার (৭ জুলাই) থেকে মুদ্রানীতিসংক্রান্ত কমিটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। আগামী ১১ জুলাই হবে কমিটির চূড়ান্ত বৈঠক। এরপর আগামী ১৮ জুলাই ঘোষণা করা হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুরো’র (বিবিএস) তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সর্বশেষ গত মে মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল। এর মধ্যে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। নিত্যপণ্যের বাজারে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। নিম্নবিত্তের নাগালের মধ্যে থাকা কাঁচা পেঁপের মতো সবজিও এখন ৬০ টাকা কেজি। গত এক যুগের মধ্যে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসে (মে পর্যন্ত) সর্বোচ্চ ১১৯ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই সূচক ছিল ১০৯ দশমিক ০২ পয়েন্ট। এক্ষেত্রে ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে ১০ দশমিক ২৭ পয়েন্ট। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গরীব ও নিম্নআয়ের মানুষেরা। উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে তাদের ক্রয় ক্ষমতা।
এমন পরিস্থিতিতে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রার প্রবাহ কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নির্ধারণ করা হয় রেপো রেট। এরপর আরো দুইবার প্রজ্ঞাপন জারি করে সুদহার বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে এটি সাড়ে ৮ শতাংশে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে দেয়া হয়। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। অপরদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার। এই সময়ে সরকারের নেওয়া নিট ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বিদায়ী অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ।
বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে, বর্তমানে যা সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে। এরপর ধীরে ধীরে তা ৬ শতাংশের ঘরে আসবে। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তার কোন প্রভাব অর্থবছর শেষ হওয়া পর্যন্ত দেখা যায়নি।
কারণ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হলেও এই সময়ে টাকা ছাপিয়ে অব্যহতভাবে অর্থের যোগান দিতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে এই নীতি কার্যকর করা যায়নি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এরপরও নতুন অর্থবছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে রেপো রেট আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার বাড়াতে আইএমএফের এই পরামর্শ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না। কেননা গত ৬ মাসে রেপো রেট এবং ক্রলিং পেগ চালু করেও কোন সফলতা আসেনি। সফলতা না পেয়েই এই হার আরো বাড়ালে তা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে এ বিষয়ে বলেন, এই মুহুর্তে রেমিটেন্স বেড়েছে, বিদেশি ঋণ এসেছে ফলে এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের উপরে ছেড়ে দেওয়ায় তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। এ মুহুর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু টাকার মান যদি খুব বেশি কমে যায় তাহলে এটা কার্যকর পদ্ধতি হবে না। সেক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে যেমন সার্কিট ব্রেকার দেওয়া হয়, তেমনি স্বল্প মেয়াদে টাকার মান নির্ধারণে পদক্ষেপ নিতে পারে। অপরদিকে রেপো রেট নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এ নিয়ে আইএমএফের পরামর্শে কোন লাভ হবে না। রেপো রেট বাড়ালেও যেটা হয়- বড় বড় শিল্পপতিরা ঠিকই লোন এবং সুদে ছাড় পায়। আর তারাই খেলাপি হয়। কিন্তু ছোট, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র যারা তারা লোন পায় না। তাদের জন্য এটা খুব অস্থিরতা তৈরী করবে।
তিনি বাজারভিত্তিক সুদহার ও বিনিময় হারের চেয়ে হুন্ডি ও অর্থপাচার রোধে আইএমএফের কাজ করা উচিত বলে মনে করেন। ড. সালেহ উদ্দীন বলেন, আমরা যে পণ্য ব্যবহার করি তার সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি এসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থান হয় এবং আয় বাড়ে। কিন্তু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে এরা দূর্ভোগে পড়বে। অতএব আইএমএফের এই পরামর্শে কোন লাভ হবে না বলেই আমি মনে করি। বরং তাদের উচিত হুন্ডি, টাকা পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এগুলো না করে শুধু বাজারের উপর ছেড়ে দিলে হবে না, কারণ আমাদের বাজার তো পারফেক্ট না। এখানেও ম্যানিপুলেট করে লোকজন।
এই মুহুর্তে এর চেয়ে কোন ভালো পদক্ষেপ আছে কিনা- এরূপ জানতে চাইলে বলেন, পদক্ষেপ বলতে এই মুহুর্তে সুদ হার ও পলিসি রেট নিয়ে ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পকে ছাড় দিতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রিফাইন্যান্সিং স্কিম করতে পারে যেন কৃষি, ছোট শিল্প, মাঝারি শিল্পতে অর্থায়ন করতে পারে। ব্যাংক থেকে বলা হয় এগুলো দেয়া হচ্ছে, কিন্তু আদতে তা তাদের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে খুব আগ্রহী না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স স্কিম আরো প্রোঅ্যাকটিভ করতে হবে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মধ্যে টাকা ছাপানো প্রসঙ্গে বলেন, এটা কন্ট্রাডিক্টরি (সাংঘর্ষিক)। শুধু প্রাইভেট সেক্টরের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, আর সরকারের জন্য সব ছাড় হলে হবে না। ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট যদি করতে চায় এবং মুদ্রাস্ফীতি যদি কমাতে চায় তাহলে সরকারকেও এর মধ্যে আনতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে জাতীয় সঞ্চয় পত্রের রেট বাড়াতে পারে, সেটা কেন করছে না। উল্টো সঞ্চয়পত্রের রেট কমিয়ে দিচ্ছে আর বাইরে থেকে ধার করছে। এটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।