নিউজ ডেস্ক:
মানিকগঞ্জের মাঝারি ধরনের নাম-ডাকওয়ালা নেতাগোছের এক ব্যক্তি সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন, নিকটাত্মীয় ও স্বজনেরা মরদেহ খাটিয়ায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থানে, চার পাশে লোকজনের কান্না আর দরুদ শরিফ পাঠের আওয়াজ। হৃদয়বিদারক আহাজারিতে পুরো পরিবেশই ভারী। এরই মাঝে ক্লিক ক্লিক… দেখা গেল, খাটিয়া বহনকারী সামনের ভদ্রলোক স্মিত হাসিতে লাশ কাঁধে নিয়ে সেলফির বীরত্বের অমর গাথা ধারণ করছেন; ক্লিক… ক্লিক…।
হালের ক্রেজ এক সঙ্গিতশিল্পী গান পরিবেশন করতে এসেছেন মফস্বল এলাকার এক মেলায়। শিল্পী মঞ্চে ওঠা মাত্রই নিরাপত্তাকর্মীদের উপেক্ষা করে শুরু হয়ে যায় সেলফি তোলার হিড়িক। শত শত মানুষের ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে বিকল হয়ে যায় সাউন্ড সিস্টেম। সঙ্গীতশিল্পীও কিছুটা ভড়কে যান। বেধে যায় হুলস্থুল কাণ্ড। পরে বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করে সঙ্গীতানুষ্ঠান।
সেলফি জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ। যুবসমাজের কাছে হয়ে উঠেছে এক রকম নেশা। আনন্দ-উল্লাস আর হই-হুল্লোড়ে সেলফির হিড়িক কারো কারো জীবন করে তুলেছে বিষাদময়।
আবার অনেকে সেলফির কারণে আজীবনের জন্য কেবলই স্মৃতি হয়ে থাকেন পরিবারের কাছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সেলফি মাধ্যম। লাশ পাশে, উঁকি দিয়ে কবরখোদকদের সেলফি, রোগী দেখা হোক অথবা কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অফিসে মিটিং চলাকালীন, কোরবানির পশুর সাথে, মাছ ধরে, কোথাও কিছু দান করতে গেলে সবচেয়ে আগে দরকার একটা সেলফি, পরে জিনিস দান হোক বা না হোকÑ সেলফিটা আগে ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে দিয়ে নিজের ফায়দা হাসিল করতে কার্পণ্য করেন না অনেকেই। চলন্ত বাইকে, ট্রেনের ছাদে, পাহাড়ের চূড়ায়, ঝরনার পানিতে, হাঁটতে, চলতে এখন সেলফি তোলার নেশা। যত্রতত্র শোনা যায় সেলফির ক্লিক ক্লিক শব্দ। আর কোনো পিকনিক, ঐতিহাসিক স্থান, জনসভা, প্রাচীন স্থাপনার কাছে গেলে তো কথাই নেই, শত শত সেলফির বাহারি মেলা বসে যায়। সেলফি নেশা কখনো কখনো ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ। অনেকের কাছে তাই সেলফি এখন আতঙ্ক।
খবরে প্রকাশ, চলন্ত মোটরসাইকেলে সেলফি তুলতে গিয়ে একসাথে প্রাণ হারিয়েছেন তিন বন্ধু। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া দীঘির পাড়ে গত বছর মোটরসাইকেলে সেলফি তুলতে গিয়েই তিন বন্ধুর করুণ মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাদেরই একটি মোবাইল ফোন থেকে সেলফি উদ্ধার হয়। এতে দেখা যায়, চার বন্ধু চলন্ত মোটরসাইকেলে। চারজনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এর মিনিট খানেকের মধ্যে অন্য একটি ছোট ট্রাকের সাথে তাদের মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। একজন দীর্ঘ দিন হাসপাতালে থেকে এখন পঙ্গু। সেলফি তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা এক বিয়েবাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। এরা হলোÑ লোহাগাড়া আমিরাবাদ হাছিরপাড়ার আবদুল মালেকের ছেলে মো: তানজিব (১৬), হাছি মিয়ার ছেলে শাকিল (১৭), মোহাম্মদ সওদাগরের ছেলে শোয়াইব (১৪) ও রাজঘাটার নুরুল ইসলামের ছেলে আকতার হোসেন (১৯)।
এমনও দেখা গেছে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় থেকে দিনের সব কাজ এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত যতসব ঘটনা সবই ঘণ্টায় ঘণ্টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে কেউ কেউ। ঘুম থেকে জেগে বিছানায় শুয়েই সেলফি তুলে এরপরÑ এখন হাতমুখ পরিষ্কার করছি, নাশতা সারছি, অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, এই মাত্র অফিসে পৌঁছলাম, বোরিং লাগছে, টুডে আই অ্যাম হ্যাপি ইত্যাদি। এমনভাবে সারা দিনের কর্মকাণ্ড সেলফির মাধ্যমে ফেসবুক-টুইটারে পোস্ট করে নগদ জানান দেয় বন্ধুদের। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানজিলা নওশিন বলেন, কোথাও গেলে সেলফি তুলে রাখি। এগুলো আসলে স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্যই করি, অন্য কিছু নয়।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সোহেল তানভীর জানান, সেলফি তুলে স্মৃতিগুলো ধারণ করি, যার ফলে অনেক দিন পর পুরনো সেই স্মৃতিগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়।
বর্তমান সময়ে অনেকের কাছেই আবার সেলফি তোলা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে সেলফি তোলা দোষ কিংবা আইনবিরুদ্ধ নয়, সেলফির কারণে ভুলে যাওয়া বন্ধু, স্থান নতুন করে মনে করিয়ে দেয়া; আবার এই সেলফির কারণেই অনেককে শনাক্ত করা সহজ হয়, কে কোন দলের, কার গ্রুপের, কোন গোছের? তবে এই সেলফির কারণেই প্রতিদিন ঘটছে অগণিত দুর্ঘটনা। কিছু অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর সেলফি আপলোড করেন অনেকেই, যা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তির কারণ। আবার সেলফি-শিকারিদের কবলে অনেক রাজনৈতিক নেতা, এমপি-মন্ত্রী কিংবা সেলিব্রেটিরাও মাঝে মধ্যে পরে যান বিব্রতকর অবস্থায়।
রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ঘটেছিল এই দুঃখজনক ঘটনাটি। ১৭ বছরের তরুণী জেনিয়া ইগনাতভিয়া সেলফি তুলতে উঠেছিল এক রেল ব্রিজের মাথায়। সেলফি তার তোলা হলো ঠিকই; কিন্তু পরমুহূর্তেই টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে যায় ৩০ ফুট উঁচু থেকে। অতঃপর মৃত্যু। সেলফি তুলতে গিয়ে গরু, ঘোড়া, মহিষ-জাতীয় হিংস্র প্রাণীর শিংয়ের গুঁতো, তাড়া, কামড় খেয়েছেন যে কতজন; তার পরিসংখ্যান বলা সত্যিই মুশকিল।
এই সেলফি এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুমূর্ষু খাদিজাকে ওঈট-তে দেখতে যেয়েও সেলফি তুলেছেন বিবেকবান মানুষেরা! কেউ কেউ আছেন যারা এমনিতেই মজা করে সেলফি তোলেন, তাতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নেই। তেমনি যারা অদূরে অবস্থানের কোনো কাক্সিক্ষত মানুষের ছবিকে ক্লোজ করে কাছে এনে সেলফি তোলেন, তারপর সে ছবিগুলো মুহূর্তেই ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। হাজার লোক দেখে, শত শত বিরূপ মন্তব্যসংবলিত কমেন্ট করে। সেগুলো মানুষের মূল্যবোধের জন্য মহাক্ষতিকর। আর এ ক্ষতিকর দিকটি দিন দিন মহামারী রূপ ধারণ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজপড়–য়া এক ছাত্রী জানান, কিছু দিন আগে পরিবারের সাথে সামাজিক দাওয়াতে যান। সেখানে খাবার খেতে বসে দেখতে পান, পাশের টেবিলে বসা তিন-চার যুবক বিভিন্ন ভঙিতে তাদের সেলফি তুলছে আর হাসাহাসি করছে। আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতাম না, তাদের ধারণ করা সেলফিতে আমাদেরও ছবি ধারণ করেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে এক বান্ধবী ফোন করে বলল, আমাদের ছবি নাকি ফেসবুকে আপলোড করা হয়েছে। এটা তো রীতিমতো অন্যায়, বিব্রত ও দৃষ্টিকটু বিষয়।
দেশের ছোট পর্দার নাট্য জগতের অতি জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল খান অনেকটা আক্ষেপের সুরে বললেন, আগে নিজ এলাকায় গেলে লোকজনের সাথে বেশ সময় নিয়ে কুশল বিনিময়, বর্তমান অবস্থাসহ নানা বিষয়ে কথাবার্তা হতো। আর বছর দুই ধরে শুধু সেলফি তুলতে চায়। তুলেই চম্পট, নেই কোনো আলাপচারিতা। আগে ঘণ্টাখানেক কথা বললেও বিরক্ত হতাম না। এখন ৫ সেকেন্ডে সেলফি তুলে হাওয়া। আন্তরিকতার ঘাটতিতে মন খারাপ হয় আমার।
সেলফি বিষয়ে শিল্প, সাহিত্য ও মননের কাগজ ‘মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদক কবি শফিক সেলিম বলেন, সেলফি হলো মানুষের নিঃসঙ্গতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতার নিদর্শন। কারণ নিজের চেহারা নিজে দেখে শান্তি নেই। অপরে দেখুক, প্রশংসা করুক, লাইক দিক, কমেন্ট করুকÑ তবেই না শান্তি। মুঠোফোনের ভেতর নিজেকে কেন্দ্রীভূত না করে আশপাশের মানুষের দিকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। তাহলেই সম্প্রীতি টিকে থাকবে জোরালো হয়ে।