শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলতি বছরই অনেক আলোচনা হয়েছে। সেখানেও আইন হয়েছে।
কাঁধে ভারী ব্যাগ বহনের ফলে শিশুরা মেরুদণ্ড, কাঁধের ব্যথাসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। আদালতের ভাষায় যাকে বলে ‘পাবলিক ইনজুরি’। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা হয়। সবাই একটি বিষয়ে একমত যে শিক্ষার্থীরা এখন লেখাপড়ার চাপে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যাগের ভারে ক্ষতির শিকার হচ্ছে শারীরিকভাবেও।
ব্যাগে কী থাকে?
ছাত্রদের ব্যাগের এত ওজন হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের জিজ্ঞেস করা হয়, রোজ ব্যাগের ভেতরে কী এমন থাকে যে ওজন এত বেশি হয়? জানা যায়, সেখানে বইপত্রের সঙ্গে টিফিন বক্স থাকে, থাকে পানির বোতল। থাকে প্রতিটি বিষয়ের একাধিক করে খাতা। একটি বাড়ির কাজের খাতা, আরেকটি শ্রেণিকক্ষে লেখার খাতা। সঙ্গে ব্যাগের নিজস্ব ওজন তো আছেই। সব মিলিয়ে গড়ে এই ওজন চার থেকে পাঁচ কেজি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছয় কেজিও ছাড়িয়ে যায়। ১০ শতাংশের হিসাবে যা হতে পারে বড়জোর দুই-তিন কেজি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এ বিষয়ে অগণিত গবেষণা হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের স্কুল অব ফিজিওথেরাপির একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, গড়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগের ওজন হয় ছয় কেজি বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি। যা শিশু বা বয়ঃসন্ধিকালের একজন শিক্ষার্থীর জন্য অনেক বেশি।
ওজনের ক্ষতি
স্কুলব্যাগের ওজনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা। কারণ শিশুদের ওই বয়সে নিয়মিত বৃদ্ধি ঘটে। ফলে কাঁধের ওপর নিয়মিত একটি ভারী বোঝা স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
ছাত্ররা দুইভাবে ব্যাগ নিয়ে থাকে। এক কাঁধে বা দুই কাঁধে। দুটিই ক্ষতিকর। এ বিষয়ে পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক শুভ প্রসাদ বলেন, ‘আমাদের শিশুরা এখন বই, খাতা, পানি ও টিফিন মিলিয়ে নিজের শরীরের ওজনের ২০ শতাংশ ওজনের ভার বহন করে থাকে। এর দুই ধরনের প্রভাব আছে, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার মধ্যে আছে, ভারী ব্যাগ যদি এক কাঁধে বহন করে নেয়, তাহলে পাশের দিকের মেরুদণ্ড একটু বাঁকা হয়ে যেতে পারে। একে স্কোলিওসিস বলা হয়। দুই কাঁধে বহন করলে ব্যাগের ওজনের কারণে শিশুকে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতে হয়। ফলে কাইফোসিস বা কুঁজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যাহত হতে পারে স্বাভাবিক উচ্চতা বৃদ্ধিও। হ্রাস পেতে পারে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা। কারণ ঝুঁকে হাঁটলে ফুসফুসের ওপর সব সময়ই একটা সম্মুখী চাপ পড়ে। স্বল্প মেয়াদের সমস্যার মধ্যে আছে মেরুদণ্ডের ব্যথা, ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা। চাপ পড়তে পারে ওই সব অঞ্চলের স্নায়ুর ওপর। ফলে হাতে-পায়ে ঝিমঝিম, অবশ হয়ে আসার মতো সমস্যা হতে পারে। এই বয়সে শিক্ষার্থীদের হাড় প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধির সময় উল্টো দিক থেকে একটা ভারী ব্যাগ এই প্রাকৃতিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কাজ করে। ’
বাড়তি ওজনের কারণ
প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থায় দুই ধরনের চিত্র দেখা যায়। প্রচলিত প্রাথমিক স্কুলগুলোতে যেখানে ভারী ব্যাগ বহন করতে হয়, সেখানে নন-ফরমাল প্রাইমারি স্কুলগুলোয় পড়ার জন্য তেমন কিছুই বহন করতে হয় না। আগে প্রথম শ্রেণিতে ওঠার আগে ‘শিশু শ্রেণি’ ছিল। যেখানে একটি শিশু শুধুই স্কুলে যাওয়া-আসা করত। স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি করাই ছিল এই শ্রেণির কাজ। এই শ্রেণিতে বই নেওয়ার চাপ থাকত না। এখন তো তিন বছর বয়স থেকেই শিশুর ওপর লেখাপড়ার চাপ দেওয়া শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সস্টিটিউটের অধ্যাপক সালমা আক্তারের মতে, শিশু বয়সে কাঁধে ব্যাগের ভার বাড়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায় আছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশুতোষ চন্দ্র সরকারের মতে, দায়টি ব্যবসায়ী, অভিভাবক—সবার। বই ব্যবসায়ীরা বই বানাচ্ছেন ও অভিভাবকরা সেগুলো চাপ দিয়ে পড়াচ্ছেন। আগে বই অনেক সহজ ও প্রাঞ্জল ছিল। এখন প্রতিযোগিতা বাড়ায় ইচ্ছামতো চাপ দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীর ওপর। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে বিষয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান।
আইনের প্রয়োগ
২০১৪ সালেও স্কুলব্যাগের ওজন নিয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছিল সরকার, যা আদতে কার্যকর হয়নি। এবারও কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে শুধু আইন করে রেখে দিলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক—সবাই।
অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘সরকার তো বিষয়টি মনিটর করবেই, স্কুলভিত্তিক বিষয়টি মনিটর করার পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া উচিত স্কুলের প্রধান শিক্ষককে। সেই সঙ্গে কমিউনিটি সুপারভিশন থাকতে পারে। থানা এডুকেশন অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এ আইনের বাস্তবায়নের জন্য স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে কমিটি—সবারই দায়িত্ব আছে। দরকার আছে পেরেন্টাল ওরিয়েন্টেশনও। ’
আশুতোষ সরকারের মতে, ‘স্কুলে স্কুলে সচেতন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরা এ বিষয়ে সচেতন থাকবেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন করার অন্যতম কারণই হলো, সেটি কার্যকর করা। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, তাহলে আইন করে কোনো লাভ হবে না। ’
দায়িত্ব নিতে পারে সাধারণ মানুষও। স্কুলগামী কোনো শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেশি মনে হলে ছাত্রটিকে সহায়তা করুন ও ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অবহিত করুন।
সমাধান
এবার দেখা যাক, কিভাবে স্কুলব্যাগের ওজন কমানো যায়। আমরা দেখছি স্কুলব্যাগের মধ্যে কী কী থাকে—বই, খাতা, পানি ও টিফিন। এবার একটি একটি করে কমানো যাক।
স্কুলই দেবে টিফিন : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পানি ও টিফিনের ভার কমপক্ষে ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজির মতো হয়ে পড়ে। স্কুল থেকে যদি বিশুদ্ধ পনি সরবরাহ করা হয়, তাহলে দিনে প্রায় এক কেজি ভার বহন থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। টিফিন বক্সের বেলায়ও এটি সত্য। মান নিয়ন্ত্রণ করে স্কুল থেকেই শিশুদের খাবার দেওয়া হলে এই ভার বহনেরও প্রয়োজন পড়ে না। তবে অভিভাবক যদি খাবার নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত থাকেন, তাহলে টিফিন বক্সকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
বাড়ির কাজ নয় : স্কুলব্যাগের ভার বাড়ানোর আরেকটি বড় উপাদান খাতা। বিষয়ের সংখ্যা যদি হয় পাঁচ, খাতার সংখ্যা এখন ১০। একটি খাতা বাড়ির কাজের, আরেকটি স্কুলের কাজের, আরেকটি কোচিংয়ের। খাতার সংখ্যার লিস্ট বাড়তেই থাকবে। খাতার এই চাপ থেকে মুক্ত করতে হলে শিক্ষার্থীকে মুক্ত করতে হবে কোচিং ও বাড়ির কাজ থেকে।
অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘অনেক বাড়ির কাজ দিয়ে দেওয়া হয় স্কুল থেকে। আমার মতে, এটুকু ছোট শিশুদের হোমওয়ার্ক দেওয়া যাবে না। স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ করে দিতে হবে। শিক্ষাটা খেলাধুলার মাধ্যমে হতে পারে, কেবলই যে শারীরিক খেলা হতে হবে, তা নয়। হতে পারে শিক্ষামূলক খেলা। উন্নত দেশগুলোয় জুনিয়র লেভেল পর্যন্ত হোমওয়ার্ক বলে কিছু নেই। হোমওয়ার্ক ও বইয়ের বোঝা যদি কমানো যায়, তাহলে ব্যাগের বোঝা এমনিতেই কমে যাবে। ’
দুই সেট বই : স্কুলব্যাগে বইয়ের সংখ্যা কমানোর স্মার্ট সলিউশন আমাদের দেশেই ইতিমধ্যে আছে। দুই সেট বই। এক সেট স্কুলের লকারে, আরেক সেট বাড়িতে। রাজধানীর কয়েকটি স্কুল এই পদ্ধতিতে কাজ করে। যাতে স্কুলে ওই ছাত্রের নামে একটি লকার থাকে। যেখানে ওই শিক্ষার্থীর এক সেট বই থাকে। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক ছাত্রের জন্য আলাদা আলাদা লকার রাখতে হবে স্কুলে। যা কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও শিশুর ভবিষ্যৎ সুস্থতার চিন্তায় এটি একেবারেই নগণ্য।
তাহলে আর ব্যাগে করে নেওয়ার মতো কিছুই রইল না। এভাবে সব কিছু সম্ভব হলে শিক্ষার্থীকে স্কুলে যেতে হবে বড়জোর একটি খাতা ও কিছু কলম নিয়ে।