বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মানুষের জীবন কেবল একটি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং একটি যুগের নৈতিক মানচিত্র এঁকে দিয়ে যায়। শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি ছিলেন তেমনই একজন মানুষ—যিনি রাজনীতিকে ক্ষমতার খেলা নয়, বরং ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। তার জীবন আমাদের শেখায়, বিপ্লব কেবল রাজপথের স্লোগান নয়; বিপ্লব শুরু হয় মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বদলের মধ্য দিয়ে।
ওসমান হাদির রাজনৈতিক চেতনার শেকড় নিহিত ছিল তার পারিবারিক ও শিক্ষাজীবনে। একজন আলেম–শিক্ষকের সন্তান হিসেবে তিনি ধর্মকে কুসংস্কার বা নিছক আনুষ্ঠানিকতার জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের দর্শন হিসেবে ধারণ করেছিলেন। ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায় তার বেড়ে ওঠা কেবল পাঠ্যজ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না—এই প্রতিষ্ঠান তাকে যুক্তিবাদী চিন্তা, বিতর্কের শৈল্পিক ভাষা এবং ভিন্নমতকে সম্মান করার মানসিকতা শিখিয়েছে। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি প্রশ্ন করতে জানতেন এবং প্রশ্নের দায় নিতে সাহসী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা তার চিন্তাকে আরও গভীর করে তোলে। রাষ্ট্র, ক্ষমতা, আধিপত্য ও প্রতিরোধ—এই বিষয়গুলো তিনি কেবল বইয়ের পাতায় দেখেননি; বরং বাস্তব রাজনীতির আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণ থেকেই তার মধ্যে জন্ম নেয় উপলব্ধি—রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক রূপান্তর। এই দর্শনই তাকে অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে আলাদা করেছে। যেখানে অনেকেই ক্ষমতার পালাবদলকে সাফল্য মনে করেন, হাদি সেখানে মানুষের মানসিক দাসত্ব ভাঙাকে প্রকৃত মুক্তি বলে বিশ্বাস করতেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল ওসমান হাদির রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত, তখন হাদি মনোযোগ দেন সাংগঠনিক ও আদর্শিক নির্মাণে। তিনি বুঝেছিলেন, রাষ্ট্র বদলালেও যদি সংস্কৃতি ও চিন্তা না বদলায়, তবে শোষণের চরিত্র কেবল বদলাবে, শোষণ বন্ধ হবে না। এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে ওঠে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ও ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’—যা ছিল একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্ল্যাটফর্ম।
ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট কিন্তু সংকীর্ণ নয়। তিনি অন্য সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখাননি; বরং নিজের সংস্কৃতিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়—ভাষা, ইতিহাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও লোকজ ঐতিহ্যের সমন্বয়—তার চিন্তায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। এই জায়গায় তিনি সংস্কৃতিকে বিনোদন নয়, বরং রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে দেখেছেন; যে অস্ত্র মানুষের চিন্তা মুক্ত করতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবনের ত্যাগ ও রাজনৈতিক দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষা ছিল ওসমান হাদির জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। গর্ভবতী স্ত্রী ও নবজাতক সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজপথ ছাড়েননি। এটি কোনো রোমান্টিক আত্মত্যাগের গল্প নয়; বরং রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের কঠিন বাস্তবতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজ যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো না যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
২০২৫ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি ছিল তার রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি নতুন পর্ব। এটি প্রমাণ করে, তিনি রাজনীতি থেকে পালাতে চাননি কিংবা কেবল আন্দোলনের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ভেতরে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো বদলাতে। তার এই সিদ্ধান্ত ছিল সাহসী, ঝুঁকিপূর্ণ এবং একই সঙ্গে দূরদর্শী।
১২ ডিসেম্বর পুরানা পল্টনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তির ওপর হামলা ছিল না; এটি ছিল একটি চিন্তা ও সম্ভাবনার ওপর আঘাত। তার চিকিৎসা, সিঙ্গাপুরে নেওয়া, এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাত—এই পুরো প্রক্রিয়া জাতিকে আবারও মনে করিয়ে দেয়, এদেশে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো এখনও কতটা বিপজ্জনক। তবুও তার মৃত্যুর পর যে গণশোক ও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা প্রমাণ করে—ওসমান হাদি একা ছিলেন না; তিনি ছিলেন বহু মানুষের কণ্ঠস্বর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে, কাজী নজরুল ইসলামের কবরের নিকটে তার সমাধি কেবল কাকতালীয় নয়; এটি যেন ইতিহাসের একটি প্রতীকী সংলাপ। একদিকে নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা, অন্যদিকে হাদির ন্যায় ও ইনসাফের স্বপ্ন—দুটি একই ধারায় প্রবাহিত। এই সমাধি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রশ্ন করবে: আমরা কি এই স্বপ্ন বহন করতে পেরেছি?
ওসমান হাদি আমাদের জন্য রেখে গেছেন কোনো সম্পদ নয়, কোনো ক্ষমতার কাঠামো নয়—বরং একটি নৈতিক দায়। তিনি দেখিয়ে গেছেন, রাজনীতি মানে কেবল জেতা-হারা নয়; রাজনীতি মানে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। তার জীবন ছিল এক দীর্ঘ প্রতিবাদী কলাম, যা রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। এই কলাম পড়া শেষ হলে আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা কি ন্যায় ও ইনসাফের সেই বাংলাদেশ গড়তে পারব, যেটার স্বপ্ন শহীদ ওসমান হাদি দেখেছিলেন?
তৌফিক সুলতান,প্রভাষক – ব্রেভ জুবিলেন্ট স্কলার্স অফ মনোহরদী মডেল কলেজ,(বি জে এস এম মডেল কলেজ)মনোহরদী, নরসিংদী।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা – ওয়েল্ফশন মানবকল্যাণ সংঘ,কাপাসিয়া, গাজীপুর।
























































