ডাঃ তৌফিক সুলতান – পেরামেডিক্স, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
মানবদেহে ঘাম একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, শরীর ঠান্ডা রাখে এবং বিপাকীয় ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু অনেকের হাত ও পায়ের তালুতে অতিরিক্ত ঘাম হয়, যা কোনো শারীরিক পরিশ্রম বা গরমের কারণ ছাড়াই দেখা দেয়। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় “পামার ও প্লান্টার হাইপারহাইড্রোসিস (Palmar and Plantar Hyperhidrosis)”। এটি শুধু শারীরিক অস্বস্তিই নয়, বরং মানসিক চাপ, সামাজিক লজ্জা ও দৈনন্দিন জীবনের অসুবিধার কারণ হয়ে ওঠে।
হাত-পা ঘামা অনেক সময় ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়। কেউ কেউ মনে করেন এটি স্নায়ুর সমস্যা, কেউ বলেন মানসিক উদ্বেগ বা ভয় থেকেই এমন হয়। আসলে এই সমস্যার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের অতিসক্রিয়তা। শরীরের এই স্নায়ুতন্ত্র স্বাভাবিক অবস্থায় ঘর্মগ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু যখন এটি অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়, তখন অতিরিক্ত ঘাম তৈরি হয়—বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের এই সমস্যা আছে, তাদের প্রায় অর্ধেকের পরিবারেও একই সমস্যা থাকে। অর্থাৎ এটি অনেক সময় বংশগতভাবেও ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া হরমোনজনিত পরিবর্তন, যেমন কৈশোর, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের সময় ঘামের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। আবার থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তা (Hyperthyroidism), ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা মানসিক উদ্বেগ থেকেও হাত-পা ঘামার সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একটু নার্ভাস হলে, সাক্ষাৎকারে গেলে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উপস্থিত হলে তার হাত-পা ঘামতে শুরু করে। এই অবস্থাকে বলে সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস, যা মানসিক চাপ বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেখা দেয়।
অতিরিক্ত ঘাম প্রথমে ছোটখাটো বিষয় মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে এটি দৈনন্দিন জীবনে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে। যেমন—লেখার সময় কলম পিছলে যাওয়া, কাগজ ভিজে যাওয়া, মোবাইল বা হ্যান্ডশেক করতে অস্বস্তি হওয়া, এমনকি পায়ের ঘামের কারণে দুর্গন্ধ বা ছত্রাক সংক্রমণ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। অনেকেই এই কারণে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, সামাজিক মেলামেশা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।
তবে সুসংবাদ হলো—এই সমস্যার কার্যকর চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপায় এখন দেশে সহজলভ্য। প্রথমেই বলা যায়, টপিকাল থেরাপি বা অ্যান্টিপারসপিরেন্ট ব্যবহার সবচেয়ে সহজ ও প্রাথমিক চিকিৎসা। এতে ব্যবহৃত হয় অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাহাইড্রেট (Aluminum Chloride Hexahydrate), যা ঘর্মগ্রন্থিকে সংকুচিত করে ঘাম কমায়। সাধারণত রাতে ঘুমানোর আগে হাতে ও পায়ে এটি লাগাতে হয়। বাজারে Drysol বা Driclor নামের প্রস্তুতিগুলো পাওয়া যায়।
পরবর্তী ধাপে আছে আয়োনটোফোরেসিস (Iontophoresis), যা আধুনিক ও নিরাপদ একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এতে হাত বা পা পানিতে ডুবিয়ে হালকা বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেওয়া হয়। এতে ঘর্মগ্রন্থি কিছু সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, ফলে ঘাম কমে আসে। সপ্তাহে কয়েকবার নিয়মিত করলে এর প্রভাব স্থায়ী হয়।
যদি এই চিকিৎসায় কাজ না হয়, চিকিৎসকরা Anticholinergic শ্রেণির কিছু মুখে খাওয়ার ওষুধ দেন, যেমন—Glycopyrrolate বা Oxybutynin। এগুলো ঘাম উৎপাদন কমায়, তবে মুখ শুকিয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য বা হালকা মাথা ঘোরার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক নয়।
আরও উন্নত চিকিৎসা হলো বোটক্স ইনজেকশন (Botulinum Toxin Type A)। এতে ঘর্মগ্রন্থির স্নায়ু সংযোগকে সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়, ফলে ৬ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত ঘাম বন্ধ থাকে। এটি অত্যন্ত কার্যকর, তবে কিছুটা ব্যয়বহুল। অনেক দেশে এখন এটি জনপ্রিয় চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সবশেষে, অন্য কোনো চিকিৎসা কাজ না করলে Endoscopic Thoracic Sympathectomy (ETS) নামের সার্জারি করা যায়। এতে বুকে অবস্থিত সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুকে কেটে বা ক্লিপ দিয়ে ঘামের প্রবাহ বন্ধ করা হয়। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন শরীরের অন্য অংশে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া। তাই এটি শেষ বিকল্প হিসেবেই বিবেচিত।
শুধু চিকিৎসাই নয়, কিছু জীবনযাপন পরিবর্তন করেও হাত-পা ঘামা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। যেমন—হাত-পা সবসময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখা, তুলার মোজা পরা, বায়ু চলাচল হয় এমন জুতা ব্যবহার করা, ক্যাফেইন, গরম বা মশলাযুক্ত খাবার কম খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা এবং নিয়মিত ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা।
হাত-পা ঘামা সাধারণত কোনো প্রাণঘাতী রোগ নয়, তবে মানসিক ও সামাজিক জীবনে এটি বড় প্রভাব ফেলে। করমর্দনের অস্বস্তি, অফিস বা শিক্ষাঙ্গনে কাজের অসুবিধা, এমনকি নিজের আত্মসম্মানে আঘাত পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা, সচেতনতা ও জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
অনেক সময় রোগীরা লজ্জার কারণে চিকিৎসকের কাছে যান না। কিন্তু জানা উচিত—এই সমস্যা গোপন করার নয়, চিকিৎসা করার। আধুনিক চিকিৎসা এখন সহজলভ্য, নিরাপদ ও কার্যকর। তাই লজ্জা নয়, সচেতনতা হোক প্রথম পদক্ষেপ। মনে রাখবেন, ঘাম কোনো অভিশাপ নয়, বরং শরীরের এক প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া—যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেই জীবনের স্বাভাবিকতা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া যায়।
তৌফিক সুলতান,প্রভাষক – ব্রেভ জুবিলেন্ট স্কলার্স অফ মনোহরদী মডেল কলেজ,(বি জে এস এম মডেল কলেজ)মনোহরদী, নরসিংদী।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা – ওয়েল্ফশন মানবকল্যাণ সংঘ,কাপাসিয়া, গাজীপুর।