নিউজ ডেস্ক:
স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। পারিবারিকভাবেই সঙ্গীতের আবহে বেড়ে উঠেছেন। সঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বেশকিছু সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। সে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার দেখা বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বলুন..
কল্যাণী ঘোষ : আমার দেখা সেই সব দিনগুলোর কথা এখন ধূসর হয়ে এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুধুমাত্র নির্বাক স্মৃতি। চট্টগ্রামে আমার জন্ম, আমি তখন সদ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ‘সেন্ট প্লাসিডস’ নামে একটি মিশনারী স্কুলে পড়তাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর সেখানের অনেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২৩ মার্চ সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যোগ দিয়েছিলাম। ২৬ মার্চের রাতে পাক বাহিনীরা গোলাগুলি শুরু করল। ২৮ মার্চ পর্যন্ত শহরে থাকার পর আমি মা-বাবা আমার ভাই প্রবাল, বোন উমাসহ সবাই চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি রাউজানের বীনাজুড়িতে। রাজাকারদের অত্যাচারে সেখানে ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারিনি। অনেক জায়গায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা শুনেছিলাম নিতুন কু-ুকে মেরে ফেলেছে। আমরা বোরখা জোগাড় করে মুখে কালি মেখে আমার পৌনে দুই বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আমরা বৃষ্টি ও বার বার বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে রাতে রামগড়ের কাছে পৌঁছলাম। খুদায় ক্লান্ত সবাই মায়ের নিয়ে যাওয়া আধা সের চাউল এক গরিব বাড়িতে গিয়ে ফুটিয়ে সবাই খেয়েছিলাম। রামগড়ের বর্ডার পার হয়ে ওপারের ত্রিপুরার সাবরুম নদী জল কম থাকায় হেঁটে পার হলাম। ওপার পার হওয়ার পর দেখলাম শরণার্থী অনেকের কলেরা দেখা দিয়েছে। কয়েকটি ট্রাক দাঁড় করান ছিল তার নিচে রাত কাটিয়ে ভোরে বাসে করে আগরতলায় পৌঁছলাম। আমার বোন উমার বসন্ত হওয়ার কারণে সেখানে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। ৫ মে আমরা কলকাতা পৌঁছলাম।
কিভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিলেন?
কল্যাণী ঘোষ : আমি ৫ বছর বয়স থেকে আমার মা লীলাবতী চৌধুরীর কাছে গান শেখা শুরু করি। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মনোমোহন চৌধুরীও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে আমি প্রথম গান করি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানের সব রকম গানের আয়োজন আমিই করতাম। সে কারণে সবাই আমাকে চিনত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় গেলাম তখন অনেক গুণী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেখানের ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আমি, আমার ভাই প্রবাল ও উমা গান করেছিলাম। এ সময় দেখা হয়েছিল ড. সনজীদা খাতুনের সঙ্গে। আমার গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। সেখানে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, জহির রায়হান, মোস্তফা মনোয়ার, ভারতের দ্বীপেন বন্দোপাধ্যায়সহ অনেকে। আমাদের ওনারা দলে নিয়ে নিলেন। আমরা ‘রূপান্তরের গান’ নামক গীতিনাট্যে গাইতাম। পরে এর নাম হয় ‘মুক্তির গান’। আমরা এটা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করতাম। জুনের প্রথমদিকে গড়িয়া হাটের মোড়ে সুরকার সমর দাস ও শিল্পী আবদুল জব্বারের সঙ্গে দেখা হয়। তারা আমাদের চিনতেন। ওনারাই আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আপনাদের কর্যক্রম কি ছিল?
কল্যাণী ঘোষ : কেন্দ্রটি ছিল কলকাতা ১৯’র ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে নিয়মিত গান রচনা, সুর ও রেকডিং হতো এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচার হতো। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি গান শেখানো হতো এবং তার রেকর্ডিংও হতো। আমরা পঞ্চাশটিরও বেশি গান করেছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। বেশিরভাগ গান ছিল সমবেত। এছাড়া একক ও দ্বৈত গানও হতো। আমি আর প্রবাল ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি পূণ্য সলীলে’ গানটি দ্বৈত রেকর্ড করেছিলাম। গানটি লিখেছিলেন বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় আর সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব’ গানটি রেকর্ড করেছিলাম আমরা তিন ভাই বোন। এটির সুর করেছিলেন সমর দাস।
শুনেছি আপনিও একটি সংগঠন করেছিলেন?
কল্যাণী ঘোষ : এরইমধ্যে আমরা ২৬ জন মিলে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম, এর সেক্রেটারি ছিলাম আমি। এ সংগঠনের হয়ে ‘একটি সূর্যের জন্ম’ নামে একটি আলেখ্য পরিবেশন করতাম। ১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনার ইতিবৃত্ত নিয়ে আলেখ্যটি রচনা করেছিলেন মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাঠও করতে তিনি। এছাড়া গণসঙ্গীত ও বিভিন্ন রকমের গান পরিবেশন করতাম।