যাবি?’ বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে ছোটভাই পলাশকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে বাবলু।
‘কোথায়?’
‘বাড়িতে।’
‘মা কি যেতে দেবে?’
‘মাকে বলার দরকার নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে মা যখন ঘুমোতে যাবে তখন যাব আমরা।’
‘মা জানতে পারলে কিন্তু মার খেতে হবে।’
‘ধুর, মা জানবে না। আমরা বিকেলের মধ্যে চলে আসব।’
‘যদি মিলিটারি আসে?’
‘ছোট মামার কাছে আমি শুনেছি-এদিকে মিলিটারি প্রতিদিন আসে না। আর আসলেও ভয় নাই। বাঁশবনে লুকিয়ে থাকব আমরা। চল, পুচি আর বুচিকে নিয়ে আসি।’
বাবলুর চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায় পলাশ। বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ায় দুই ভাই। বাড়ি মানে বাংলাদেশ।
সময়টা একাত্তরের মধ্য জুন। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের তাণ্ডব। পাকবাহিনীর হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ। পাখির মতো প্রতিদিন গুলি করে মানুষ শিকার করছে ওরা। রক্তের দাগ সর্বত্র।
বাবলুদের বাড়ির কাছেই ভারত সীমান্ত। উঠোনে দাঁড়ালেই দূর থেকে বেশ পরিষ্কার দেখা যায় সবকিছু। জুনের শুরুর দিকে বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামের আরো অনেকের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় বাবলুরা। কারণ ততদিনে ক্রমশ গ্রাম-গঞ্জে ঢুকে পড়েছে পাক আর্মি।
তাবু টানিয়ে ওপারে আশ্রয় নিলেও বাবলুদের মন পড়ে থাকে এপারে। তাবুর সামনে দাঁড়ালে দূর থেকে ওদের বাড়িটাকে ছবির মতো দেখা যায়। এক দৌড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু মিলিটারির ভয়ে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হয় প্রায়ই।
মাঝে মাঝে অবশ্য মিলিটারির চোখ ফাঁকি দিয়ে মায়ের সঙ্গে ঘুরে আসে দুইভাই। সারাদিন থেকে এটা-ওটা নিয়ে ফের চলে আসে উদ্বাস্তু শিবিরে। অবশ্য এভাবে যাওয়াটা কম বিপদের নয়। কখন মিলিটারি চলে আসে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই তো, দিন চারেক আগের কথা। ওদের পাশের বাড়ির মজিদ কাকু বাড়ি গিয়ে ধরা পড়ে যান মিলিটারির হাতে। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির উঠোনে লাশ হয়ে পড়ে থাকেন মানুষটা।
নিতান্তই প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয় শিবিরে উঠেছিল বাবলুরা। মূল্যবান জিনিসপত্র প্রায় সবকিছুই রয়ে যায় বাড়িতে। সেসব রাখার মতো জায়গা আশ্রয় শিবিরে নেই। তাই ঘরভর্তি জিনিসপত্র রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাড়ি ছাড়তে হয় বাবলুদের। সবাইকে আশ্রয় শিবিরে তুলে দিয়ে সেদিনই আবার যুদ্ধে চলে যায় ওদের বাবা।
বাবলু এবং পলাশের খুব মন খারাপ হয় ওদের পোষা হাঁস দুটির জন্য। দুভাই মিলে ওদের নাম রেখেছে পুচি এবং বুচি। আশ্রয় শিবিরে পুচি আর বুচিকে রাখার মতো জায়গা না থাকায় সেদিন বাবা ওদের সঙ্গে নিতে দেয়নি। তারচেয়ে বাড়িতে থাকলে এখানে-সেখানে চরে ভালোই থাকবে হাঁস দুটি-এই ছিল বাবার যুক্তি।
দুপুরের পর খেয়ে-দেয়ে ওদের মা ঘুমিয়ে পড়তেই দুই ভাই চুপি চুপি বেরিয়ে আসে আশ্রয় শিবির থেকে। শিবিরে গিজগিজ করছে চেনা-অচেনা অসংখ্য মানুষ। সবার চোখ এড়িয়ে একটু হাঁটতেই দুই ভাই চলে আসে বর্ডারের কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে ওদের বাড়িটা। গুটি গুটি পায়ে দুভাই এক সময় পা রাখে বাংলাদেশের মাটিতে। চোখ ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই ওপারে আশ্রয় শিবিরটা পরিষ্কার দেখা যায়।
মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই ওরা উঠে আসে বড় রাস্তায়। রাস্তা পার হলেই ওদের বাড়ি। চারপাশের বাড়িগুলো সব ফাঁকা। সবাই ওপারের আশ্রয় শিবিরে। চারদিকে কেমন যেন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ। রাস্তা পার হয়ে ওরা ঢুকে পড়ে মুন্সি বাড়ির বাঁশবনে। বাঁশবনে প্রায়ই মুক্তি বাহিনীর লোকজন এসে যুদ্ধের নানা ছক আঁকে। জায়গাটা বাবলুর চেনা। কয়েক কদম হাঁটতেই সেখানে চলে আসে ওরা। এই মুহূর্তে কেউ নেই সেখানে।
এদিক-ওদিক তাকাতেই হঠাৎ চমকে ওঠে বাবলু। ওর দৃষ্টি স্থির হয় কৌটার মতো গোলাকার একটা বস্তুর ওপর। এক নজর দেখেই সেটি চিনতে পারে ও। কদিন আগেই বাবার কাছে দেখেছিল বাবলু। একটা গ্রেনেড। মনে হয় মুক্তি বাহিনীর লোকজন ভুল করে ফেলে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে গ্রেনেডটা তুলে নেয় বাবলু। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাবধানে সেটি ঢুকিয়ে ফেলে প্যান্টের পকেটে। কীভাবে মুখ খুলে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে হয় বাবার কাছ থেকে এরমধ্যে শিখে নিয়েছিল সে। তাই খুব একটা ভয় লাগে না আর।
পলাশ অবাক হয়ে বলল, ‘কী ওটা?’
‘কিছুনা, চল।’ বলেই সামনে হাঁটতে লাগল বাবলু। যথারীতি তার পিছু নিল পলাশ। বাঁশবন ছেড়ে এক দৌড়ে দুই ভাই চলে আসে বাড়ির আঙ্গিনায়। এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ে পুচি আর বুচিকে। নিশ্চিন্তে বাড়ির এক কোণে ঘুমিয়ে আছে ওরা।
হঠাৎ একটা শব্দে আঁতকে ওঠে বাবলু। শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। নিজের অজান্তেই বাবলুর একটা হাত চলে যায় প্যান্টের পকেটে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাবলুর ডান হাতটা চেপে ধরে পলাশ। মুখে আঙ্গুল চেপে পলাশকে নিয়ে দ্রুত বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ের গাছ-গাছালির ঝোপে লুকিয়ে পড়ে দুই ভাই।
একটা গাড়ি এসে থামে বাবলুদের ঠিক উঠোনে। একে একে পাঁচ থেকে ছয়জন পাক আর্মি একের পর এক নেমে আসে গাড়ি থেকে। সবাই সশস্ত্র। ওদের সঙ্গে পাশের গ্রামের দেলু রাজাকারও নেমে আসে এক সময়।
গাড়ির শব্দে উঠে দাঁড়ায় পুচি আর বুচি। উঠেই অবলা প্রাণী দুটি ডাকতে থাকে শব্দ করে। হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে বন্দুকের নল তাক করে একজন। তারপর দুপুরের নিরবতা ভেঙে গর্জে ওঠে বন্দুকটি। একের পর এক বুলেটে ঝাঁঝরা হতে থাকে পুচি আর বুচি। লাফাতে লাফাতে ওরা একসময় লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সেদিকে তাকিয়ে পিশাচের মতো হাসতে থাকে হিংস্র হায়নাগুলো।
ঝোপের আড়ালে বসে চোখের সামনে প্রিয় পুচি আর বুচিকে এভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে হতবাক হয়ে যায় কিশোর বাবলু। জলে ছলছল করতে থাকে ওর চোখ দুটি। মুখ ঢেকে কেঁদে উঠতেই দ্রুত পলাশের মুখ চেপে ধরে সে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় পলাশ। হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে বাবলুর। নিজের অজান্তেই হাত ঢুকে যায় প্যান্টের পকেটে। তারপর সেখান থেকে বের করে আনে কুড়িয়ে পাওয়া সেই গ্রেনেডটি। বাড়ির উঠোন থেকে ওদের দূরত্ব বড়জোর পঞ্চাশ থেকে ষাট গজ।
মিলিটারির দল একে একে যখন গাড়িতে উঠছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাবা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিল ঠিক সেভাবে মুখ খুলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারে বাবলু। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে দুপুরের শান্ত আকাশ। গাড়ির ঠিক দু-তিন হাত সামনেই পড়ে গ্রেনেডটি। মুহুর্তেই আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সেটি। সঙ্গে পুড়তে থাকে এক দল হায়না। ঝোপের আড়াল থেকে এক সময় উঠে দাঁড়ায় বাবলু। তরপর অবাক বিস্ময়ে নিজেই নিজের বিরত্ব দেখতে থাকে বাবলু।