নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশে এবার বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে অর্ধ-কোটিরও বেশি দুর্গত মানুষ।
এছাড়া বন্যা কবলিত অন্তত ৩২টি জেলায় ঘরবাড়ি ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, সাধারণ মানুষ ও খামারিরা বিপাকে পড়েছেন তাদের পোষা গবাদি পশু হাঁস-মুরগির নিয়ে।
বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রতিবছরই বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়। বাংলাদেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা সেটি নির্ভর করে।
অতিবৃষ্টির কারণে নেপাল, ভারতের আসাম ও বিহারে এবার বন্যা হয়েছে। জুনের শেষ দিক হতে ক্রমাগত ভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায় এবং নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রমের ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এবছর বন্যাকে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ এর মতো বড় বন্যার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের তিনটি নদী অববাহিকার ৩৪৩ পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে।
এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০ টি পয়েন্টের মধ্যে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে দেখা যাচ্ছে এবছর ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যেটি সর্বকালের সবচে বেশি। ১৯৮৮ সালে পানি ১১২ সেন্টিমিটার ও ১৯৯৮ সালে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মোঃ সাজ্জাদ হোসেন এবার বন্যার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, ‘এবছর ১১-১৩ আগস্ট যমুনায় গড়ে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার করে বেড়েছে। আমি যদি ফুটে কনভার্ট করি সেটা প্রায় দেড় ফুটের মতো। এর আগে এত অল্প সময় এতটা পানি এত দ্রুত বাড়েনি। এর কারণ হলো যমুনার উজানে খুব কাছাকাছি জায়গায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ‘
মি. হোসেন বলেন, পদ্মার পানি কিছু জায়গায় বিপদসীমার উপরে আছে এবং এ কারণে পদ্মা তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এখন বন্যা হচ্ছে। তবে গঙ্গা তথা পদ্মার পানি ১৯৮৮ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার উপরে ছিল।
কিন্তু এবছর ২২ আগস্টের হিসেবে পদ্মার পানি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
অন্যদিকে ১৯৮৮ সালের বন্যায় মেঘনা নদীর ভৈরব বাজার পয়েন্টে পানির উচ্চতা বিপদসীমার ১৮১ সেন্টিমিটার উপরে ছিল এবং ১৯৯৮ সালে সেটি ১০৮ সেন্টিমিটার উপরে দিয়ে প্রবাহিত হয়। সে তুলনায় এবার পানি এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। ২২ শে আগস্ট সেখানে পানি সমতল ছিল বিপদসীমার ২৭ সে.মি. নিচে।
সাজ্জাদ হোসেন জানান এবার উত্তরাঞ্চলে দুই দফা বন্যা হয়েছে, ‘যমুনার পানি জুলাইয়ের ৬ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত পানি বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল ১৪ তারিখ থেকে পানি কমে। কমার পর ১৭-১৮ তারিখ পানি বিপদসীমার নিচে নেমে যায়। পরবর্তীতে আবার আগস্ট মাসে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সেখানে পানি ১০ তারিখ থেকে বৃদ্ধি পায়। পানি এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এগার তারিখ বার তারিখ থেকে আবার বিপদসীমার উপরে উঠে যায়। ‘
বুয়েটের পানি সম্পদ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক উম্মে কুলসুম নাভেরা বলেন, ‘১৯৮৮ সালে যেটা হয়েছিল যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দুটো নদীর পানির উচ্চতা একসঙ্গে বেড়ে গিয়েছিল। এবার আমরা হয়তো সেটি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ব্রহ্মপুত্রতে যখন পিক আসলো অনেকে প্রেডিক্ট করেছিলেন যে ১৯ আগস্ট দুটো একসঙ্গে মিট করতে পারে এবং ২১শে আগস্ট আমাবস্যার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেশি থাকবে তখন আরেকটা ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারতো। কিন্তু সেটা আমরা পার হয়ে এসেছি। ‘
অধ্যাপক নাভেরা বলেন, বাংলাদেশ বন্যার গ্রহণযোগ্য পূর্বাভাস দিতে পারছে এখন প্রয়োজন ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া।
‘এই ছোট্ট দেশটায় প্রায় ১১০০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে। এবারে যত খবর এসেছে তাতে কিন্তু বলা হচ্ছে বাঁধ ভেঙে গেছে। আমাদের এখন সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে এই বাঁধগুলো রক্ষার জন্য। কারণ আমাদের বাংলাদেশে সিভিয়ার মেইনটেনেন্সের সমস্যা এই বাঁধগুলোর ক্ষেত্রে। ‘
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ৬১% ও ১৯৯৮ সালে ৬৮% এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও এবার এখন পর্যন্ত এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির হয়নি। কিন্তু হাওরে আগাম বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে দুই দফা বন্যায় এবার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন