১৭ জনকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতি পূরণ দেওয়ার নির্দেশ
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি :চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসার সময়ে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ১৭ জনকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল রোববার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারকে ৫ লাখ টাকা এবং অপারেশনের সময় ব্যবহৃত ওষুধ আমদানি ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান আইরিশ কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা করে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ২৯ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘চক্ষু শিবিরে গিয়ে চোখ হারালেন ২০ জন!’ শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনে নিয়ে জনস্বার্থে করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল চূড়ান্তভাবে নিস্পত্তি করে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই রায় দেন। এর আগে গত ১৩ আগষ্ট উভয়পক্ষের শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেছিল হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার দিন থেকে একমাসের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। এরপর হাইকোর্টে এফিডেভিটের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রায়ে, চোখ হারানো ১৭ জনসহ মোট ২০ জনকে আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে চুয়াডাঙ্গা ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারকে নির্দেশ দেন আদালত। আদালত তার আদেশে বলেন, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের বাইরে অন্য কোনো হাসপাতালে এই ২০ জনের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে, সে চিকিৎসাও নিশ্চিত করতে হবে। সে চিকিৎসার ব্যয়ও ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারকেই বহন করতে হবে। রায়ে বলা হয়, চক্ষু শিবিরে গিয়ে চোখ হারানো সংক্রান্ত পুরো ঘটনার জন্য ইম্প্যাক্ট কমিউনিটি হেলথ সেন্টার সম্পূর্ণভাবে দায়ী। তারা কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। তা ছাড়া আইরিশ ঔষধ কোম্পানি গত ২০ বছর ধরে রেজিষ্ট্রেশন ছাড়া বাজারে ঔষধ বিক্রি করে আসছে। এ জন্য তাদেরকেও এ দায় বহন করতে হবে। আদালত বলেন, প্রায়শই এ ধরনের ঘটনা বিভিন্ন এলাকায় ঘটে থাকে। যা খুবই দুঃখজনক। এজন্য চিকিৎসা অবহেলার তদারকির জন্য মেডিকেল কোন আইন নেই। এসব অবহেলাজনিত কারণ উদঘাটন এবং তদারকি করতে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। যার প্রধান থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রণায়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। ওই কমিটিতে মেডিকেল ও আইন বিষয়ে দুইজন অভিজ্ঞদের রাখতে বলা হয়েছে। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্র্টের অ্যাডভোকেট অমিত দাশ গুপ্ত। তাকে সহায়তা করেন সুভাষ চন্দ্র দাস, রিনা পারভীন ও মো. শাহিনুর রহমান। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও আইরিশ কোম্পানির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রফিকুল ইসলাম। রায়ের পর আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত বলেন, চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনের মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে চোখ হারানো ১৭ জনকে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। টাকা পরিশোধ করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে হবে। গত ২৯ মার্চ একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চুয়াডাঙ্গার ইমপ্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেল্থ সেন্টারে তিন দিনের চক্ষু শিবিরের দ্বিতীয় দিন ৫ মার্চ ২৪ জন নারী-পুরুষের চোখের ছানির অপারেশন করা হয়। অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহীন। তবে বাসায় ফেরার পর ২০ জন রোগীর চোখে ইনফেকশন দেখা দেয়। এসব রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ মার্চ অপারেশনের পর ৬ মার্চ তাদের প্রত্যেককেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে ওই দিনই কারও বিকেলে, কারও সন্ধ্যায়, কারও বা রাত থেকে চোখে জ্বালা-যন্ত্রণা ও পানি ঝরতে শুরু করে। পরদিনই তারা যোগাযোগ করেন ইম্প্যাক্ট হাসপাতালে। তাদের তখন গুরুত্ব না দিয়ে কোনো রকম চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠলে ফের তারা ইম্প্যাক্টে যান। সেখান থেকে কয়েকজন রোগীকে স্থানীয় এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্থানীয় ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। এদের মধ্যে চারজন রোগী নিজেদের উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্বজনদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইম্প্যাক্ট থেকে ১২ মার্চ একসঙ্গে ১৬ জন রোগীকে ঢাকায় নেওয়া হয়। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ৫ মার্চের ওই অপারেশনের ফলে এদের চোখের এত ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে যে, ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়েছে। পরে চোখ হারানো প্রত্যেকের পক্ষে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। সেই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত চোখ হারানো ১৭ জনকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে ১ এপ্রিল রুল জারি করেন আদালত। এরপর গত ১৭ জুলাই হেলথ সেন্টারে চোখ হারানোর ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। যার প্রথমটি গত ১৩ মে এবং দ্বিতীয়টি ১৫ জুলাই চূড়ান্ত করা হয়। প্রথম প্রতিবেদনে চুয়াডাঙ্গায় চোখ হারানোর জন্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত হাসপাতালের ওষুধ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি থেকে সংক্রামক জীবাণু ছড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রতিবেদনে জীবানুর সংক্রামককে চোখ হারানোর জন্য দায়ী করে এ ঘটনাকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ ও ‘দুর্ঘটনাজনিত’ বলা হয়েছে। এছাড়া ওই চক্ষু শিবিরে ব্যবহৃত কিছু ওষুধে এখনও পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশন প্রদান (ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক) করা সম্ভব হয়নি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। ওই প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ব্যার্থতার কারণেই এ দেশে রোগীদের এত ভোগান্তি। তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।