শিরোনাম :
Logo আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাচ্ছেন ইবি ভিসি Logo সিরাজগঞ্জে জেলা পুলিশের মাসিক কল্যাণ ও অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত Logo কচুয়ার পালাখাল রোস্তম আলী ডিগ্রী কলেজে নবীন বরণ ও ওরিয়েন্টেশন ক্লাস অনুষ্ঠিত Logo শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারের সাময়িকী  ” মুক্তবাক” এর মোড়ক উন্মোচন Logo খুলনার কয়রায় প্রায় ১০৩ কেজি হরিণের মাংস, মাথা এবং হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ১ জন হরিণ শিকারিকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড Logo জসিম সভাপতি, ফখরুল সম্পাদক দীর্ঘ ছয় বছর পর চাঁদপুর জেলা সমিতি ইউকের নির্বাচন সম্পন্ন Logo নির্ধারিত ছয় মাসের আগেই নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত হবে: প্রধান উপদেষ্টাকে কমিশন চেয়ারম্যান Logo ইবি অভয়ারণ্যের শরৎ সম্ভাষণ: “গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছোঁয়া ও বায়োস্কোপের রঙিন আবেশ” Logo চাঁদপুর সদরের ১৪ ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগে সেবা প্রার্থীদের হয়রানি ও ভোগান্তি কমেছে Logo চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বদলী জনিত বিদায় সংবর্ধনা

সংঘর্ষে ২জন নিহতের ঘটনায় কামারখন্দে দুই গ্রাম পুরুষ শুন্য নারী ও শিশু খাদ্য সংকট

  • Nil Kontho
  • আপডেট সময় : ০৫:৩১:৩৬ অপরাহ্ণ, বুধবার, ১২ জুলাই ২০১৭
  • ৭৪১ বার পড়া হয়েছে

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ  একটি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২৮জুন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের পাইকশা ও বাগবাড়ি গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষে ২জন নিহতের ঘটনায় পুলিশের গ্রেফতার আতংকে ওই দুই গ্রাম এখন পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ঘরবাড়িতে ঝুলছে তালা। হাট বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারী তাঁত কারখানাসহ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে সকল ধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকায় নারী ও শিশুদের খাবার, ওষুধ, গবাদী পশুর খাদ্য, চিকিৎসা সেবাসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া, ওই এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার নেই বললেই চলে। গত ৬ জুলাই থেকে জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা শুরু হলেও ওই দুই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন স্কুলসহ ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির কারণে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গ্রহণ বন্ধ রয়েছে। এতে করে ওই এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে রবিবার ও মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার সর্ববৃহৎ পাইকশা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকার সকল রাস্তা মানুষ শুন্য।  রবিবার ও বুধবার হাটের দিন পাইকোশা বাজারে কমপক্ষে ১০থেকে ১৫হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। অথচ, ওই বাজারের ১৫ দিন যাবত সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। লোকজনের চলাচল নেই বলেই চলে। দুই-একজন বৃদ্ধ ও মহিলাদের দেখা মিললেও তারা অপরিচিত ব্যক্তি দেখলেই দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান।
ওই সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ফরিদুলের বাড়িতে গিয়ে চোখে পড়ে স্বজন হারানোর শোকের মাতম। সংবাদকর্মীদের দেখে শোকে শয্যাশায়ী নিহত ফরিদুলের মায়ের আহাজারিতে পরিবেশ ভাড়ি হয়ে ওঠে। বাড়ির উঠানে ছেলে নিহতের পর থেকে তসবীহ্ হাতে বিলাপ করছেন। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ। শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশী নারীরা। আর বাবা দানেছ আলী প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলায় আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসময় কথা হয় নিহত ফরিদুলের দাদা হাজী আবুল হোসেনের (৭০) সাথে।  তিনিও নাতি হারানোর শোকে পাথর হয়ে গেছেন। এসময় কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, একদিকে নাতিকে হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। অপরদিকে, প্রতিপক্ষের মামলার আসামী হয়ে পুলিশের ভয়ে তার তিন ছেলেসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এলাকা ছাড়া। একারণে ঘরে চাল, ডাল, ওষুধপত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না থাকায় ও সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মঙ্গলবার দুপুরে বাগবাড়ি গ্রামের নিহত শিপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। তার বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। পরে, বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কথা হয় ওই দুই গ্রামের কিছু সাধারণ মানুষের সাথে। তাদেরই একজন একই ইউনিয়নের খামার বড়ধুল গ্রামের পল্লী চিকিৎসক এস.এম জাহিদুল ইসলাম জানান, এলাকায় ১৪৪ধারা জারির কারণে দোকান খুলতে দেয়না পুলিশ। রোগী বা কেউ ওষুধ কিনতে আসলে আমাকে ফোন করে। আমি পুলিশের অনুমতি নিয়ে তাদের সেবা দিয়ে আবারও দোকান বন্ধ করে রাখি।
পাইকশা গ্রামের গৃহবধূ মায়া খাতুন (৩০) জানান, এঘটনায় প্রতিপক্ষের মামলায় তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক আসামী হয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন। এ কারণে তাদের তাঁতের সুতা, ভীম, ত্যানা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পোকায় কাটছে। এতে তাদের পরিবার লোকসানের মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন ।
একই এলাকার বৃদ্ধা চায়না (৬০) বেওয়া জানান, সকাল-বিকেল তার ওষুধ না খেলে চলেনা। কিন্তু বাজারে ওষুধের দোকান বন্ধ থাকায় এবং বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় তার ওষুধ খাওয়া বন্ধ রয়েছে। এতে তিনি আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। পাইকশা গ্রামের গৃহবধু মমতা বেগম বলেন, আমার বাবা লালচাঁন (৮৫) গত শুক্রবার রাতে বাধক্যজনিত কারণে মারা যান। কিন্তু এলাকায় পুরুষ মানুষ না থাকায় ওইদিন তার দাফন করা যায়নি। পরের দিন পাশ্ববর্তী এলাকার আত্মীয় স্বজন এসে তার জানাযা ও দাফনকার্য সম্পন্ন করেন। কোনাবাড়ী হাই স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী আশা খাতুন জানায়, তাদের স্কুলের অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গত ৬ জুলাই থেকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুই গ্রামের সংঘর্ষে ২জন নিহত হওয়ায় এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একারণে পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। পাইকশা ইসলাম নগর দারুল সুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক শফিকুল ইসলাম ও কম্পিউটার শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, এ ঘটনার পর থেকে তাদের মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। গত ৩ তারিখে মাদ্রাসা খোলা হলেও মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ৬শ’ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৮/১০জন উপস্থিত ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাজার থেকে কাঁচা বাজারসহ নিত্য প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারীর সাথে। তারা জানান, নিজ এলাকার বাজার-ঘাট বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে চরমভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাই বাধ্য হয়ে পাশের গ্রাম থেকে কাঁচা বাজার করে বাড়ি ফিরছেন। তবে, এমন পরিস্থিতি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ চান উভয় গ্রামবাসী। এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন ঠান্ডু বলেন, সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে আমি উভয় পক্ষের লোকজনকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কোন পক্ষকে ইন্ধন দেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে কামারখন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, ঘটনাটি মীমাংসার উদ্যোগ নিলেও উভয় গ্রামে পুরুষ শুন্য থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, úরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। কামারখন্দ থানার ওসি বাসুদেব সিনহা দু’গ্রাম পুরুষ শুন্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এঘটনায় উভয় পক্ষ থেকে মোট ৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে ১৬জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে।
এব্যাপারে কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন বলেন, ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়নি। তবে, আইন শৃংখলা স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
উল্লে¬¬খ্য, একটি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের পাইকশা ও বাগবাড়ি গ্রামবাসীর দু’গ্রুপের মধ্যে বুধবার (২৮জুন) বিকেলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় গ্রামের কমপক্ষে ১৫টি দোকান, বাড়িঘর ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৩০জন আহত হন। পুলিশ ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় পাইকশা গ্রামের আহত কলেজ ছাত্র ফরিদুলকে(২৫) সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পথে এবং বগুড়া জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎধীন অবস্থায় পরদিন বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বাগবাড়ি গ্রামের কলেজ ছাত্র শিপন(২০) মারা যায়।
এঘটনায় নিহত যুবক ফরিদুলের বাবা দানেজ আলী এবং শিপনের মা শেফালী বেগম বাদি হয়ে পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এছাড়া, ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষ থেকে  দ্রুত বিচার আইনে আরো দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত উভয় পক্ষের ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাচ্ছেন ইবি ভিসি

সংঘর্ষে ২জন নিহতের ঘটনায় কামারখন্দে দুই গ্রাম পুরুষ শুন্য নারী ও শিশু খাদ্য সংকট

আপডেট সময় : ০৫:৩১:৩৬ অপরাহ্ণ, বুধবার, ১২ জুলাই ২০১৭

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ  একটি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২৮জুন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের পাইকশা ও বাগবাড়ি গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষে ২জন নিহতের ঘটনায় পুলিশের গ্রেফতার আতংকে ওই দুই গ্রাম এখন পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ঘরবাড়িতে ঝুলছে তালা। হাট বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারী তাঁত কারখানাসহ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে সকল ধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকায় নারী ও শিশুদের খাবার, ওষুধ, গবাদী পশুর খাদ্য, চিকিৎসা সেবাসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া, ওই এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার নেই বললেই চলে। গত ৬ জুলাই থেকে জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা শুরু হলেও ওই দুই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন স্কুলসহ ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির কারণে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গ্রহণ বন্ধ রয়েছে। এতে করে ওই এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে রবিবার ও মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার সর্ববৃহৎ পাইকশা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকার সকল রাস্তা মানুষ শুন্য।  রবিবার ও বুধবার হাটের দিন পাইকোশা বাজারে কমপক্ষে ১০থেকে ১৫হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। অথচ, ওই বাজারের ১৫ দিন যাবত সকল দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। লোকজনের চলাচল নেই বলেই চলে। দুই-একজন বৃদ্ধ ও মহিলাদের দেখা মিললেও তারা অপরিচিত ব্যক্তি দেখলেই দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান।
ওই সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ফরিদুলের বাড়িতে গিয়ে চোখে পড়ে স্বজন হারানোর শোকের মাতম। সংবাদকর্মীদের দেখে শোকে শয্যাশায়ী নিহত ফরিদুলের মায়ের আহাজারিতে পরিবেশ ভাড়ি হয়ে ওঠে। বাড়ির উঠানে ছেলে নিহতের পর থেকে তসবীহ্ হাতে বিলাপ করছেন। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ। শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশী নারীরা। আর বাবা দানেছ আলী প্রতিপক্ষের দায়ের করা মামলায় আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসময় কথা হয় নিহত ফরিদুলের দাদা হাজী আবুল হোসেনের (৭০) সাথে।  তিনিও নাতি হারানোর শোকে পাথর হয়ে গেছেন। এসময় কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, একদিকে নাতিকে হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। অপরদিকে, প্রতিপক্ষের মামলার আসামী হয়ে পুলিশের ভয়ে তার তিন ছেলেসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন এলাকা ছাড়া। একারণে ঘরে চাল, ডাল, ওষুধপত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না থাকায় ও সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মঙ্গলবার দুপুরে বাগবাড়ি গ্রামের নিহত শিপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। তার বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। পরে, বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কথা হয় ওই দুই গ্রামের কিছু সাধারণ মানুষের সাথে। তাদেরই একজন একই ইউনিয়নের খামার বড়ধুল গ্রামের পল্লী চিকিৎসক এস.এম জাহিদুল ইসলাম জানান, এলাকায় ১৪৪ধারা জারির কারণে দোকান খুলতে দেয়না পুলিশ। রোগী বা কেউ ওষুধ কিনতে আসলে আমাকে ফোন করে। আমি পুলিশের অনুমতি নিয়ে তাদের সেবা দিয়ে আবারও দোকান বন্ধ করে রাখি।
পাইকশা গ্রামের গৃহবধূ মায়া খাতুন (৩০) জানান, এঘটনায় প্রতিপক্ষের মামলায় তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক আসামী হয়ে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন। এ কারণে তাদের তাঁতের সুতা, ভীম, ত্যানা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পোকায় কাটছে। এতে তাদের পরিবার লোকসানের মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন ।
একই এলাকার বৃদ্ধা চায়না (৬০) বেওয়া জানান, সকাল-বিকেল তার ওষুধ না খেলে চলেনা। কিন্তু বাজারে ওষুধের দোকান বন্ধ থাকায় এবং বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় তার ওষুধ খাওয়া বন্ধ রয়েছে। এতে তিনি আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন। পাইকশা গ্রামের গৃহবধু মমতা বেগম বলেন, আমার বাবা লালচাঁন (৮৫) গত শুক্রবার রাতে বাধক্যজনিত কারণে মারা যান। কিন্তু এলাকায় পুরুষ মানুষ না থাকায় ওইদিন তার দাফন করা যায়নি। পরের দিন পাশ্ববর্তী এলাকার আত্মীয় স্বজন এসে তার জানাযা ও দাফনকার্য সম্পন্ন করেন। কোনাবাড়ী হাই স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী আশা খাতুন জানায়, তাদের স্কুলের অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা গত ৬ জুলাই থেকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুই গ্রামের সংঘর্ষে ২জন নিহত হওয়ায় এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একারণে পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। পাইকশা ইসলাম নগর দারুল সুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক শফিকুল ইসলাম ও কম্পিউটার শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, এ ঘটনার পর থেকে তাদের মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। গত ৩ তারিখে মাদ্রাসা খোলা হলেও মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ৬শ’ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৮/১০জন উপস্থিত ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাজার থেকে কাঁচা বাজারসহ নিত্য প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারীর সাথে। তারা জানান, নিজ এলাকার বাজার-ঘাট বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে চরমভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাই বাধ্য হয়ে পাশের গ্রাম থেকে কাঁচা বাজার করে বাড়ি ফিরছেন। তবে, এমন পরিস্থিতি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ চান উভয় গ্রামবাসী। এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন ঠান্ডু বলেন, সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে আমি উভয় পক্ষের লোকজনকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কোন পক্ষকে ইন্ধন দেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে কামারখন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন চৌধুরী বলেন, ঘটনাটি মীমাংসার উদ্যোগ নিলেও উভয় গ্রামে পুরুষ শুন্য থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, úরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। কামারখন্দ থানার ওসি বাসুদেব সিনহা দু’গ্রাম পুরুষ শুন্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এঘটনায় উভয় পক্ষ থেকে মোট ৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে ১৬জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে।
এব্যাপারে কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন বলেন, ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়নি। তবে, আইন শৃংখলা স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
উল্লে¬¬খ্য, একটি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের পাইকশা ও বাগবাড়ি গ্রামবাসীর দু’গ্রুপের মধ্যে বুধবার (২৮জুন) বিকেলে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় গ্রামের কমপক্ষে ১৫টি দোকান, বাড়িঘর ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৩০জন আহত হন। পুলিশ ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় পাইকশা গ্রামের আহত কলেজ ছাত্র ফরিদুলকে(২৫) সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পথে এবং বগুড়া জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎধীন অবস্থায় পরদিন বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বাগবাড়ি গ্রামের কলেজ ছাত্র শিপন(২০) মারা যায়।
এঘটনায় নিহত যুবক ফরিদুলের বাবা দানেজ আলী এবং শিপনের মা শেফালী বেগম বাদি হয়ে পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এছাড়া, ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষ থেকে  দ্রুত বিচার আইনে আরো দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত উভয় পক্ষের ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে।