নিউজ ডেস্ক:
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।’ (হুজরাত:১০) এ আয়াতটি দুনিয়ার সব মুসলমানকে এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এ আয়াতের দাবি ও গুরুত্ব কী, বহু হাদেসে রাসূলুল্লাহ সা: বর্ণনা করেছেন। এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো : হজরত আবু হোরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান-মাল ও ইজ্জত হারাম (মুসলিম ও তিরমিজি) করেছেন। হজরত আবু সাইদ খুদরী রা: ও আবু হোরায়রা রা: বলেন, নবী সা: বলেছেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। যে তার ওপরে জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্রজ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই। (মুসনাদে আহমাদ) হজরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী নবী সা: এ হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, ঈমানদারদের সাথে একজন ঈমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ঈমানদারদের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট, ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে। (মুসনাদে আহমাদ)
ইসলামের পবিত্রতম সম্পর্কের ভিত্তিতে তারা একে অপরের ভাই এবং আল্লাহর ভয়েই তাদেরকে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয় এসব বড় বড় অন্যায়ের পথ রুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একে অপরের ইজ্জতের ওপর হামলা একে অপরের মনোকষ্ট দেয়া, একে অপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা এবং একে অপরের দোষত্রুটি তালাশ করা পারস্পরিক শত্রুতা সৃষ্টির মূল কারণ। এসব কারণ অন্যান্য কারণের সাথে মিশে বড় বড় ফিতনা বা সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
এ সব নির্দেশের আলোকে মানহানি (খধি ড়ভ ষরনবষ) সম্পর্কিত বিস্তারিত আইন-বিধান রচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশের মানহানির আইন আছে কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ নেই। শুধু মামলা দায়ের পর্যন্তই শোনা যায়, এরপর হারিয়ে যায়। পাশ্চাত্যের মানহানি সম্পর্কিত আইন এ ক্ষেত্রে এতটাই অসম্পূর্ণ যে, এ আইনের অধীনে কেউ মানহানির অভিযোগ পেশ করে নিজের মর্যাদা আরো কিছু খুইয়ে আসে। পক্ষান্তরে ইসলামি আইন প্রত্যেক ব্যক্তির এমন একটি মৌলিক মর্যাদার স্বীকৃতি দেয় যার ওপর কোনো আক্রমণ চালানোর অধিকার কারো নেই। এ ক্ষেত্রে হামলা বাস্তবতা ভিত্তিক হোক বা না হোক এবং যার ওপর আক্রমণ করা হয় জনসমক্ষে তার কোনো সুপরিচিতি মর্যাদা থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অপমান করেছে শুধু এতটুকু বিষয়ই তাকে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। তার মানে কাউকে অপমান করা ইসলাম এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। তবে এ অপমান করার যদি কোনো শরিয়তসম্মত বৈধতা থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
বিদ্রুপ করার অর্থ কেবল কথার দ্বারা হাসি-তামাশা করাই নয়। বরং কারো কোনো কাজের ব্যঙ্গাত্মক অভিনয় করা, তার প্রতি ইঙ্গিত করা, তার কথা, কাজ, চেহেরা বা পোশাক নিয়ে হাসাহাসি করা অথবা তার কোনো ত্রুটি বা দোষের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাতে অন্যদের হাসি পায়। এ সবই হাসি-তামাশার অন্তর্ভুক্ত। মূল নিষিদ্ধ বিষয় হলো, কেউ যেন কোনোভাবেই কাউকে উপহাস ও হাসি-তামাশার লক্ষ্য না বানায়। কারণ এ ধরনের হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা বিদ্রুপের পেছনে নিশ্চিতভাবে নিজের বড়ত্ব প্রদর্শন এবং অপরকে অপমানিত করা ও হেয় করে দেখানোর মনোবৃত্তি কার্যকর, যা নৈতিকভাবে অত্যন্ত দোষণীয়। তা ছাড়া এভাবে অন্যের মনোকষ্ট সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় দেখা দেয়। এ কারণে কাজকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রুপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর গোনার কাজে প্রসিদ্ধি লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।’(হুজরাত:১১)
এ নির্দেশের আরো উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো ব্যক্তিকে এমন নামে ডাকা না হয় অথবা এমন উপাধি না দেয়া হয় যা তার অপছন্দ এবং যা দ্বারা তার অবমাননা ও অমর্যাদা হয়। যেমন কাউকে ফাসেক বা মুনাফেক বলা। কাউকে খোঁড়া, অন্ধ অথবা কানা বলা। কাউকে তার নিজের কিংবা মা-বাপের বংশের কোনো দোষ বা ত্রুটির সাথে সম্পর্কিত করে উপাধি দেয়া। কোনো ব্যক্তি, বংশ, আত্মীয়তা অথবা গোষ্ঠীর এমন নাম দেয়া যার মধ্যে তার নিন্দা ও অপমানের দিকটি বিদ্যমান।
ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও সে কুভাষী হবে এবং অসৎ ও অন্যায় কাজের জন্য বিখ্যাত হবে এটা একজন ঈমানদারের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। কোনো কাফের যদি মানুষকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাস করা কিংবা বেছে বেছে বিদ্রুপাত্মক নাম দেয়ার ব্যাপারে খুব খ্যাতি লাভ করে তাহলে তা মনুষত্বের বিচারে যদিও সুখ্যাতি নয় তবুও অন্তত তার কুফরির বিচারে তা মানায়। কিন্তু কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আখিরাত বিশ্বাস করা সত্ত্বেও যদি এরূপ বিশেষণে ভূষিত হয় তার জন্য পানিতে ডুবে মরার শামিল।