বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
নিউজ ডেস্ক:বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করে আওয়ামী লীগ যে অন্যায় করেছে তা দেশের জনগণ কোনো দিন মেনে নেবে না। এ জন্য জনগণের কাছে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে। সব মিলিয়ে দেশে আজ ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। তিনি বলেন, দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। ঐক্য দিয়েই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। বৃষ্টি উপেক্ষা করে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দেন। শহীদ হাদিস পার্কে স্থান না হওয়ায় নেতা-কর্মীরা আশপাশের সড়কে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তব্য শোনেন।পরে বিএনপি মহাসচিব তাঁদেরকে শান্ত করেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা এমন দেশে বাস করছি, যেখানে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। দিনে দুপুরে আদালতের মধ্যেই কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, গণপিটুনির নামে মানুষ মারা হচ্ছে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে সরকারের মদদে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার দেশবিরোধী বক্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, প্রিয়া সাহার বক্তব্যে দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিন্তু তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সে সুযোগে তিনি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তাঁর বক্তব্যই নাকি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। দেশবাসী জানতে চায়, আসলেই এটা প্রিয়া সাহার বক্তব্য না প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। দেশকে অকার্যকর করতে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত চলছে।
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, দেশ এখন ভয়াবহ একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছে। একটি ভয়াবহ সংকট চলছে। একটি দল বার বার ক্ষমতায় এসে সব সময় গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। গত কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাচ্ছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিচার পাওয়ার আশা এখন দুরাশা।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে পরাজিত করার জন্য আমরা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলাম। একটি মহল অত্যন্ত উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাঁরা বলছে, বিএনপি যে সমাবেশ করছে, বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে গেছে, ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে পরিষ্কার ঘোষণা দিতে চাই, ২০ দলীয় জোটও ঠিক আছে, ঐক্যফ্রন্টও ঠিক আছে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সরকারকে পরাজিত করব।’ বিএনপির মহাসচিব বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি শুধু বিএনপি নেত্রী নয়, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আপোষহীন নেত্রী। যে নেত্রী গণতন্ত্রের জন্য এত সংগ্রাম করলেন, স্বৈরাচারের হাত থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করলেন, তাঁকে কারাগারে দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে। খবর পেয়েছি তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে সঠিক চিকিৎসাও করা হচ্ছে না। সুচিকিৎসার জন্যও তাঁর মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, যে গণতন্ত্রকে আওয়ামী লীগ হরণ করে নিয়েছে, যে গণতন্ত্রকে সরকার ডাকাতি করে নিয়ে গেছে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে সামনে দেখতে চায়, কাছে পেতে চায়।
মির্জা ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। একটি রায়কে হাতিয়ার করে তারা এটা করেছে। এ সরকার জনগণের ভোটের অধিকার নষ্ট করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তারা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে। জনগণ আজ ভোট দিতে পারে না। ৩০ তারিখ ভোটের আগের দিন ২৯ তারিখ ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার যে বাজেট দিয়েছে সেই বাজেটের মূল উদ্দেশ্য জনগণের পকেট কাটা। ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট লুটপাট করা হয়েছে। এখন মা-বোনেরা নিরাপদ নয়। বিচার বহির্ভূত হত্যা করা হচ্ছে। মানুষ এখন ডেঙ্গু ও পিটিয়ে মারার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশে এখন আইনের শাসন নেই, কোনো বিচার নেই। ফখরুল আরও বলেন, সরকার সাধারণ মানুষের চিন্তাও করছে না। কৃষক ও শ্রমিক আজ তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পাটকল শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার এখন দেউলিয়া সরকার, জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার উন্নয়নের ঢোল পেটায়, উন্নয়নের ঢোল বাজায়। উন্নয়ন হচ্ছে-রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা সুন্দরবন ধ্বংস করবে। সরকারকে এক দিন জনগণের আদালতে দাঁড়াতে হবে।
সমাবেশে বিশেষ অতিথি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আদালতের দায়িত্ব এখন হয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর হুকুম তামিল করা। খালেদা জিয়ার মুক্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করা। এই সরকারের পতন হলে খালেদার মুক্তি মিলবে, জনগণেরও মুক্তি মিলবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমান সরকার একটি মামলাবাজ সরকার। দেশের গণতন্ত্র বারবার জবাই করেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। তারা এখন বন্ধু। আর বিএনপি বারবার গণতন্ত্র পুনুরুদ্ধার করেছে। তিনি বলেন, এই সরকার এডিস মশা ঠিকমতো মারতে পারে না, তবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঠিকই মারতে পারে। মশা কামড়ালে তবু অনেকে ভালো হয়ে যায়, এই সরকারের অনেক লোক আছে যারা রক্ত চুষে চুষে খেয়েই চলেছে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়াকে বিপাকে ফেলতে সরকার দুদককে ব্যবহার করেছে। সরকার ওই মামলায় আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। বিচারকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। সরকারের প্রভাবের কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার জামিন হবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাই আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে।
খুলনা নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান সমাবেশে সঞ্চালনা করেন। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাড. নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সৈয়দ মেহেদী আহামেদ রুমী, কবির মুরাদ, যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন। নির্বাহী কমিটির সম্পাদক ও সহসম্পাদকদের মধ্যে বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, মানবাধিকার সম্পাদক অ্যাড. আসাদুজ্জামান আসাদ, সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জয়ন্ত কুমার কু-ু, সহপ্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল, সহধর্ম সম্পাদক অমলিন্দু অপু, সহ ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক নেওয়াজ হালিমা আরলি। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, তাঁতী দলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও মৎস্যজীবী দলের যুগ্ম আহবায়ক এ কে এম ওয়াজেদ।
খুলনা বিভাগের বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাড. এস এম শফিকুল আলম মনা, যশোর জেলার আহ্বায়ক অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, বাগেরহাট জেলার সভাপতি এম এ সালাম, সাতক্ষীরা জেলার আহ্বায়ক রহমতউল্লাহ পলাশ, নড়াইল জেলা সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, মেহেরপুর জেলার সভাপতি মাসুদ অরুন ও মাগুরা জেলা সভাপতি আকতার হোসেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেন খুলনা থেকে রকিবুল ইসলাম বকুল, যশোর থেকে মফিকুল হাসান তৃপ্তি, কুষ্টিয়ার রেজা আহমেদ বাচ্চু, সাতক্ষীরার ডা. শহিদুল আলম, যশোরের আবুল হোসেন আজাদ ও ইঞ্জিনিয়ার টি এস আইয়ুব, চুয়াডাঙ্গার মো. শরীফুজ্জামান শরীফ, মেহেরপুরের জাভেদ মাসুদ মিল্টন, ঝিনাইদহের সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, মাগুরার মনোয়ার হোসেন খান, কুষ্টিয়ার ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন, ঝিনাইদহের অ্যাড. এম এ মজিদ। এ সমাবেশে খুলনা বিভাগের বিএনপির ১১টি সাংগঠনিক জেলা ও সেগুলোর উপজেলার বিভিন্ন নেতারা সমাবেশে অংশ নেন।
এ দিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মো. শরীফুজ্জামান শরীফ দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দেন। এ ছাড়া এর আগের দিন গত বুধবার চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ওয়াহেদুজ্জামান বুলা ও খন্দকার আব্দুল জব্বার সোনা চুয়াডাঙ্গা থেকে রওনা দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে খুলনায় উপস্থিত হয়ে গতকালের খুলনা বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দেন।