নিউজ ডেস্ক:’
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ত্যাগের মহিমায় নিজেদের গড়ে তোলার জন্য দেশের নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা বীরের জাতি, যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। একথা কখনোই ভুললে চলবে না। আমরা বিজয়ী জাতি, কারোর কাছে মাথানত করে চলি না, চলবো না। সারা বিশ্বের সামনে বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা সবসময় মাথা উঁচু করে চলবো। দেশে যাতে আর কোনো অন্যায়-অনিয়ম না হয়, বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে, যুগের পর যুগ এভাবেই বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকতে পারে- বিজয়ের দিনে এই আমাদের প্রতিজ্ঞা।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শনিবার বিকালে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বক্তৃতায় তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সবাইকে হত্যা করে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পুরো রক্তকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। দেশবাসী আমাদের দেশ সেবার সুযোগ দেওয়ার কারণেই বাংলাদেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলছি। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল।
বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, যে মর্যাদা ’৭৫-এ ভুলুণ্ঠিত হয়েছিল। সারা বিশ্ব এখন বাঙালিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের এই বিজয় সবাইকে ধরে রাখতে হবে।
গণভবন থেকে এই ভিডিও কনফারেন্সে সূচনা বক্তব্যের পর সোহওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সরাসরি প্রশ্নেরও উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
গণভবনে এ সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মের কয়েক তরুণের সঙ্গে জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালে গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ওই স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
বক্তব্যের শুরুতেই দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণের পথ ধরেই আমাদের এই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর একটিমাত্র ভাষণে দেশের প্রতিটি ঘর এক একটি দুর্গে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ বাঙালি জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে। হাতে গোনা কয়েকটি রাজাকার-আলবদর ও পাকিস্তানের দোসর ছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানি শত্রুদের পরাজিত করে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে।
তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বীর বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানের ৯৬ হাজার সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ পাক হানাদাররা গণহত্যা চালানোর পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শেষ শত্রু থাকা অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ অপরাধে পাক হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক চাপে এবং তাদের ৯৬ হাজার সৈন্যের প্রাণ বাঁচানোর কারণে পাক হানাদারদাররা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এই ঐতিহাসিক উদ্যানেই বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তার নির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারাবিশ্বের ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান পাওয়ার কারণে সমগ্র বাঙালির সম্মান অনেক উচ্চস্তরে পৌঁছে গেছে, বাঙালি জাতির কাছে এটি গৌরবেরও।
মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজয় দিবসের এই দিনে ঘৃণা ও ধিক্কার জানাই যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের দোসর হিসেবে আমাদের মা-বোনদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘৃণা জানাই যারা রাজাকার-আলবদর-আলশামস হয়ে সারা দেশে গণহত্যা চালিয়েছে, আমাদের পরাজিত করতে চেয়েছে, কিন্তু আমরা পরাজিত হয়নি। বরং বীর বাঙালিরা তাদেরই পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছে।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর পাক হানাদাররা আমাদের মা, বোন, ভাইসহ পরিবারের সবাইকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে বন্দী করে রেখেছিল। ১৬ ডিসেম্বর যখন পাক হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে, বাইরে জয় বাংলার গগনবিদারী স্লোগান, তখনও আমরা ওই বাড়িতে বন্দী। বাইরে মানুষের স্লোগানের সঙ্গে আমরাও পাক হানাদারদের সামনেই বাড়ির ভেতর থেকে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছি। দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও আমরা মুক্তি পেয়েছি ১৭ ডিসেম্বর।
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবো।