১৯৭০ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। ২০০৩ সালে হাসপাতালটির শয্যা ৫০ থেকে ১০০ তে উন্নীত করা হয়। কিন্তু খাতা কলমে ১০০ শয্যায় রূপ নিলেও শুধু খাবার ও ওষুধ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়েনি অন্যান্য সুবিধা। হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ রয়েছে ২২টি।
এর মধ্যে ২০টি পদে স্থায়ী জনবল নেই। ফলে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিকতার ঘাটতি না থাকলেও অতিরিক্ত এই রোগীর চাপ সামাল দিতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে, ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ১০০ শয্যার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালকে ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ছয়তলা ভবনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। কিন্তু উদ্বোধনের পর পাঁচ বছর পার হলেও নতুন ভবনটির পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়নি। হাসপাতালটিতে ২৫০ শয্যার জনবল তো দূরের কথা এখনো অনুমোদন হয়নি ১০০ শয্যার জনবলেরও।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখ যায়, বর্তমানে হাসপাতালের শিশু ও মেডিসিন ওয়ার্ডে অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। অতিরিক্তসহ ২০ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৫ জন নতুন শিশু ভর্তিসহ ১৪৭ জন শিশু চিকিৎসাধীন ছিল। এদিন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৭৮ জন শিশু। এরপরেও ওয়ার্ড ছাপিয়ে শিশুদের হাসপাতালের করিডোর, সিঁড়ির নিচে, এমনকি টয়লেটের পাশেও বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। কোথাও পা ফেলার জায়গা সেখানে নেই। শুধুমাত্র শিশু ওয়ার্ডেই অতিরিক্ত রোগীর চাপ নয়, হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডেই শয্যা সংখ্যার থেকে কয়েকগুণ বেশি রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়াও বর্হিবিভাগেও প্রতিদিন অন্তত ৭০০-৮০০ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। হাসপাতালে আসা রোগীরা জনবল ও চিকিৎসক সংকট, ব্যবস্থাপনাসহ নানা সমস্যার কারণে সেবা পাচ্ছেন না। ভোগান্তিরও যেন অন্ত নেই অসহায় রোগী ও স্বজনদের।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে ২০টি পদে স্থায়ী জনবল নেই। তবে সিনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিক), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিক ও সার্জারি), মেডিকেল অফিসারের তিনটি পদ, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার হোমিও এবং আয়ুর্বেদিক পদে অন্য হাসপাতালের চিকিৎসক সংযুক্ত করা হয়েছে। ৫০ শয্যার জনবলেও শূন্য রয়েছে সিনিয়র কনসালট্যান্ট (চক্ষু), অ্যানেস্থেসিয়া, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু), মেডিসিন ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (ইএনটি), রেডিওলজি এবং মেডিকেল অফিসারের পদ।
এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির ৬৭টি পদের মধ্যে নার্সিং সুপারভাইজারের দুটি পদই শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ রয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে ৫১ পদেই স্থায়ী জনবল নেই। অন্য হাসপাতালের নার্স দিয়ে পদগুলো পূরণ করা হয়েছে। মাত্র দুটি পদে স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া নার্স রয়েছে। শূন্য রয়েছে একটি পদ। তৃতীয় শ্রেণির জনবলের পদ রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে অফিস সহকারী, হেলথ এডুকেটর ও মেডিসিন টেকনিশিয়ান (ইকো) পদে স্থায়ী জনবল রয়েছে। বাকি পদগুলো পূরণ করা হয়েছে অন্য হাসপাতালের জনবল দিয়ে।
এদিকে, রোগীদের চিকিৎসা সেবার শঙ্কট আরও বাড়িয়েছে ২০১৬ সাল থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) হিসেবে সংযুক্ত থাকা ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন বদলীজনিত কারণে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেব যোগদান করায়। এছাড়াও দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে ২০১৪ সাল থেকে সংযুক্ত থাকা জুনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডা. মো. আবুল হোসেনের অবসর গ্রহণ। ফলে এই দুটি সার্জারি ও মেডিসিন ওয়ার্ডের রোগীরা সব থেকে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শিউলী খাতুন জানান, ‘সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৩টি। অতিরিক্তসহ এই ওয়ার্ডের মোট ১৭টি শয্যা রয়েছে। অথচ এই শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ১৫০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন থাকছেন। এই পরিমাণ রোগীর জন্য মাত্র চারজন সিনিয়র স্টাফ নার্স ডিউটি করছেন। ফলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। দায়িত্বে থাকার সময়ে তাদের দম ফেলারও সময় মিলছে না।’
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও তার স্বজনরা জানান, দুই-তিন দিন ভর্তি থাকার পরেও শয্যা না পাওয়ায় মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। অতিরিক্ত রোগীর ভিড়ে রোগীরাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন।
মায়ের চিকিৎসার জন্য গতকাল সদর হাসপাতালে এসেছিলেন সেলিম উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে এত রোগী আগে দেখিনি। টিকেট নেয়ার জন্যও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। আর ডাক্তার দেখানোর জন্য চেম্বারের সামনে আরও দীর্ঘ লাইন ঠেলতে হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা না বাড়ালে আমাদের ভোগান্তি কমবে না।’
জন্ডিসে আক্রান্ত শিশু সন্তানকে নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন তারেক মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘দুই দিন ধরে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে থাকলেও বেড পাইনি। এত বেশি রোগী যে বাধ্য হয়ে ওয়ার্ডের করিডোরে বিছানা পেতে অবস্থান করতে হচ্ছে। নার্স এবং ডাক্তার একবারের বেশি আসছেন না।’
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ রবিন বলেন, ‘হাসপাতালটি ১০০ শয্যা ও এই পরিমাণ রোগীর জন্য ওষুধ এবং খাবার সরবরাহ থাকলেও সাড়ে তিন শতাধিক রোগী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকেন। আবহাওয়াজনিত কারণে বর্তমানে শিশু ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা সব থেকে বেশি। অতিরিক্তসহ ২০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছে ১৫০ জনের অধিক। জনবল এবং চিকিৎসক সংকট থাকায় হাসপাতালের অতিরিক্ত রোগীর পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা এবং চিকিৎসকসহ সকল জনবল বাড়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ জানাতে চাই, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা হোক।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হাসান বলেন, ‘সদর হাসপাতালটিতে বর্তমানে প্রতিটি শয্যার বিপরীতে আড়ায় গুণ বেশি রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে। যার কারণে হাসপাতালের জনবল ৫০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার কার্যক্রম চলছে। ফাইলটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে হাসপাতালের রিক্রুটমেন্ট অনুযায়ী জনবল নিয়োগ করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে জনবল রয়েছে, রোগীর সংখ্যা যায় থাকুক তারাই সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা সেবার বিষয়ে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, নিউমোনিয়া ও সর্দি-জ্বরের প্রাদুর্ভাবের কারণে শিশু ওয়ার্ডে দেড়শর বেশি শিশু ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। দুজন শিশু বিশেষজ্ঞ থাকায় শিশুদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা সম্ভব হলেও অন্যান্য সহযোগী জনবল কম থাকায় সেবা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।’



















































