৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি হয়ে উঠে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় ৩৫ বছর আগে। ক্ষমতাশীন দলের ছাত্রসংগঠনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাকসু বাস্তবায়নে শতশত কর্মসূচি পালন করেছে বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এ আন্দোলন এখন আরও তীব্র হয়েছে। রাকসুর দাবিতে নতুন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন প্রশাসনের বিরুদ্ধেও পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচী। ছাত্রসংগঠনগুলোর অভিযোগ আগের আওয়ামী প্রশাসনের মতোই ছলচাতুরী করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে চায় এই প্রশাসন। ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, রাকসু কার্যকর করতে ব্যর্থ হলে উপাচার্য পদত্যাগের ১দফা দাবিতে মাঠে নামবেন তারা।
উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ৫ মাসের মধ্যে রাকসু নির্বাচন কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব। ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং তফসিল দায়িত্ব গ্রহণের মাসেই প্রকাশিত হবে বলে আস্বস্তও করেছিলেন। এই লক্ষে ছাত্রশিবির-ছাত্রদলসহ ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক অফিসিয়াল বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তফসিল ঘোষণা হয়নি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
রাকসু সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পরে এখন পর্যন্ত মোট ১৪ বার রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ও রুহুল কুদ্দুস বাবু এক বছরের জন্য যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া সামরিক শাসনের জন্য ১৯৭৫-১৯৮০ এবং ১৯৮১-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত ছিল। ১৯৮৯ সাল এর পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে।
গত ১৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু)-র গঠনতন্ত্র অনুমোদন এবং ২০২৫-২৬ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে সাত সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এই নির্বাচন কমিশন গঠনের পর শুধু সভা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি।
গত ২৩ জুন নির্বাচন কমিশনের মিটিংয়ের খবর শুনে রাকসু ভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন শাখা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে রাকসু কোষাধ্যক্ষের কার্যালয় ঘেরাও করে দাবি আদায়ের হুশিয়ারি দেন শাখা সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল। এসময় তিনি বলেন, রাবি প্রশাসন সর্বপ্রথম রাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিলো। কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তির বলে তা বাস্তববায়িত হয়নি, আমরা তা জানতে চাই। দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে নকীব প্রশাসনের (উপাচার্য) পদত্যাগের ১ পফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে।
এদিন (২৩ জুন) রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর ড. মো. আমজাদ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তফশীল ঘোষণার তারিখ প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাকসু নির্বাচন কমিশন ২০২৫-এর সিদ্ধান্তক্রমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) এর নির্বাচনী তফশীল আগামী ২৮ জুলাই সিনেট ভবনে ঘোষণা করা হবে। রাবির ওয়েবসাইটে ঐ ঘোষণার পরে তফশীল পাওয়া যাবে।
এর আগে (২১ জুলাই), ছাত্র সংসদ (রাকসু) নিয়ে প্রশাসনের তালবাহানার প্রতিবাদ, তফসিল ঘোষণা ও বাস্তবায়নে এক দফা দাবিতে প্রশাসন ভবনের সামনে অনির্দিস্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন সাবেক সমন্বয়ক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনিরপেক্ষ ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো পর্যন্ত আমাদের একটি ন্যায্য দাবিও মানেনি এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিরপেক্ষতার ন্যূনতম আস্থাও তৈরি করতে পারেনি। এই প্রশাসন বারবার প্রমাণ করেছে তারা একপক্ষীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। আমরা চাই নির্বাচন—কিন্তু সেই নির্বাচন হতে হবে এমন, যেখানে সকল ছাত্র সংগঠন সমান সুযোগ পাবে, প্রশাসন থাকবে নিরপেক্ষ এবং শিক্ষার্থীরা থাকবে নিরাপদ ও আস্থাশীল। অন্যথায়, এই নির্বাচন হবে কেবল একটি নিছক নাটক—যা গণতন্ত্রের অপমান এবং শিক্ষার্থীদের বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল (বাবু) বলেন, আমরা সবসময় রাকসু কার্যকরের দাবীতে সরব ছিলাম, এখনো আছি। প্রশাসনকে শুরুর দিকে আন্তরিক মনে হলেও একটি দলের অযাচিত এবং অযৌক্তিক দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন আয়োজনে গড়িমসি করছে। রাকসু নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা যেমন শিক্ষার্থীরা মানবেনা। অন্যদিকে ১০/১২ বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করা বুড়ো/অছাত্রদের নির্বাচনে অনার নাটক মঞ্চায়ন করলে তাও মেনে নেওয়া হবে না।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহবায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, রাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের একটি প্লাটফর্ম। অন্য ছাত্র সংগঠন গুলোর সাথে এ ব্যাপারে আমরা একমত। প্রশাসনের গাফিলতির কারণে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। প্রশাসনের প্রতি আমাদের দাবি যেন দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর ড. মো. আমজাদ হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে রাকসু নির্বাচন হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই একধরনের জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। সেটা দূর করতে হবে। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন হঠাৎ একটি নির্বাচন ডেট দিয়ে দিতে পারে না। একটা প্রস্তুতি আছে। সেই সময়টাই আমরা নিয়েছি। ২৮ জুলাই সকল অংশীদারদের সহযোগিতা থাকলে একটা ডেট হয়ে যাবে বলে আশা করছি। আমাদের কোন চেষ্টার ত্রুটি নেই। এবারের রাকসু একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে।
রাকসুর সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘প্রতিদিনই নতুন নতুন বিষয় সামনে আসছে। সেগুলোকে এডজাস্ট করেই আমাদের এগুতে হচ্ছে। এবং এতে করে একটা দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিলম্ব তৈরি হচ্ছে। এই জট খুলতে খুলতেই আমরা এগোচ্ছি।’
গত ২৩ জুন নির্বাচনের দাবিতে ভবনটি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন শাখা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এসময় তারা ভবনটি লাল রং করে।