নিউজ ডেস্ক:
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যার নিরব সাক্ষী হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য ‘৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষদের ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশের স্তূপ করে গণকবর দেওয়া হয়। সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ভাস্কর রাশা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও যুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র কয়েকটি ভাগে উপস্থাপন করেছেন ভাস্কর রাশা। এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটিতে দুটি চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। ১৯৮৮ সালে এ ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করা হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটু এগিয়ে গেলে নতুন ভবনের সামনে চোখে পড়ে ভাস্কর্যটি। এর একটি অংশে সবচেয়ে বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাতকে। এ অংশে দেখানো হয়েছে- ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছে, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, গর্ভবতী মাকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে, লাশ ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে।
ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ। তার ওপর একটি শকুন বসে আছে। এটি সে সময়ের বাংলাদেশের প্রতীক। ভাস্কর্যটির অপর অংশে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ। তাই এতে কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সব স্তরের মানুষের যুদ্ধকালীন সময়ের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ‘যার যা কিছু আছে’ অনুসারে দা, বঁটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা, সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে মানুষ- এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ভাস্কর্যে। এর পর দেখানো হয়েছে সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুদ্ধে নামার পরে যখন যোদ্ধারা বুঝতে পারে যে, পুরাতন পদ্ধতি দিয়ে তাদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তখন সবাই প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। এখানে রয়েছে সব বয়সি নারী ও পুরুষ।
ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধস্পৃহার ছাপ রয়েছে। ভাস্কর্যে সবার মাথা একটু সোজা, মুখ লাল বর্ণের। এর কারণ হলো- রাগ হলে কালো মানুষের চেহারাও লাল বর্ণ ধারণ করে। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধূসর। কারণ, এটি আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি।
ভাস্কর্যের নিচে রয়েছে পানি, এটি দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, এটি দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাবর্ধনের অদ্বিতীয় শিল্পকর্ম। এমনকি এটি দেশের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের ও গণহত্যার গুচ্ছ ভাস্কর্য।
এর চারদিকে আছে অপরূপ সৌন্দর্যময় পানির ফোয়ারা। ফোয়ারা ছাড়লে নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাতের বেলায় রঙিন বাতির আলোয় এর রূপ আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের নির্মম কালো অধ্যায় তুলে ধরার এ ভাস্কর্যটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা অসম্পূর্ণ রয়েছে। ভাস্কর রাশা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যে এর দুটি তুলে ধরা হয়েছে। এখনো বাকি তিনটি অংশ সম্পন্ন করতে পারেননি রাশা।
এদিকে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি আরো সম্প্রসারণ করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মীজানুর রহমান। এ ছাড়া এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, ঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনাসংবলিত প্লেট সংযোজন করা হবে। ক্যাম্পাসে জায়গার স্বল্পতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাস্কর্যটির জন্য যা যা প্রয়োজন তা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে এর কোনোটাই করা হয়নি। অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি। পানির ফোয়ারা বেশ কয়েকটা দীর্ঘ দিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ভাস্কর্যটির আস্তরণ খুলে পড়ছে। এতে এর সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। ভাস্কর্যটির সংরক্ষণের দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে জবি ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম, এটা অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার কারণে হয়েছে। এই ভাস্কর্যটি সচেতনভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভাস্কর্যটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এটা কাম্য নয়। আমরা কয়েকদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ভাস্কর্যটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছি। এখনো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি তারা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই ভাস্কর্যটি সংরক্ষণের জোর দাবি জানাই।