|| মোবারক আলী ও মহিউদ্দিন আহমেদ ||
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সাফল্যের পর, জনগণের প্রত্যাশা বাংলাদেশ আর যেন না ফিরে যায় শেখ হাসিনার দুঃশাসনে কিংবা পুরনো ধাঁচের রাজনীতিতে। এ প্রত্যাশা বাস্তবায়নে এখন জরুরি প্রয়োজন রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল রাজনৈতিক সংস্কার। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে কিভাবে এ সংস্কার কার্যকর করা যাবে। কিভাবে আগামী নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। সেই সাথে, নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ডের’ নিশ্চয়তা দেয়াও অপরিহার্য। অবশ্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত দুই দশকে আমরা দেখেছি, সংবিধানের দোহাই দিয়ে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারদলীয় সরকারের অধীনে আয়োজন করেছে। কারো কাছে এটি পুরোপুরি অযৌক্তিক না হলেও, বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির যে প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে, তা জনগণের আস্থার মারাত্মক ক্ষতি করেছে । ফলে জনগণের প্রত্যাশা হলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। তবে আপাতত তত্ত¡াবধায়ক সরকার ইস্যুটি গৌণ। কারণ বাস্তবতা হলো ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেবল নির্দলীয় সরকার থাকলে কি মাঠপর্যায়ে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে?
প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার বাস্তবতা
আমরা জানি, প্রশাসনের অনেক উচ্চপদে এখনো পলাতক ফ্যাসিস্টদের অনুসারী বা দলীয় অনুগতদের প্রভাব আছে। পুলিশ, ডিসি, এসপি বা টিএনও তাদের অনেকে কোনো-না-কোনো দলের আশীর্বাদে এসব পদে এসেছেন। তাদের ওপর নিরপেক্ষ আচরণের দায়িত্ব দিলে, বাস্তবে তার ফল কী হবে তা সহজে আন্দাজ করা যায়
তাই আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে-
১. ভোট কেন্দ্র নিরাপদ ও সুষ্ঠু রাখতে প্রতিটি ভোট কেন্দ্র্রে সিসি ক্যামেরা থাকতে হবে। কোনো ভোটারকে ভয় দেখানো বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের অভিযোগ উঠলে ঘটনাটি কখন, কোথায় এবং কিভাবে ঘটেছে, তা রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে যাচাই ও তদন্ত করা যাবে।
২. প্রযুক্তির ব্যবহার- ব্যালট স্ক্যানিং মেশিন : ইভিএম সিস্টেম চালু করার দরকার নেই। ইভিএম নিয়ে জনগণের মধ্যে যেমন অনাস্থা রয়েছে, তেমনি কারচুপির সুযোগ থাকে। তাই প্রয়োজন এর পরিবর্তে কানাডিয়ান ধাঁচের ব্যালট স্ক্যানিং মেশিন (অপটিক্যাল স্ক্যানার) ব্যবস্থা চালু করা। এ পদ্ধতিতে ভোটার নিজ হাতে ব্যালট পেপারে ভোটের চিহ্ন দেবেন। এরপর ব্যালটটি একটি ফোল্ডারে ভরে ট্যাবুলেটরের সামনে থাকা স্ক্যানিং মেশিনে প্রবেশ করানো হবে। মেশিনটি তাৎক্ষণিকভাবে ভোটটি ডিজিটালভাবে রেকর্ড করবে এবং ব্যালটটি একটি সুরক্ষিত বাক্সে সংরক্ষণ করবে। ভোট গ্রহণ শেষে রেকর্ড করা তথ্যের ভিত্তিতে মেশিনটি দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে ফল প্রকাশ করবে। এতে ভোটার ও প্রার্থীর আস্থা বাড়বে, কারণ ব্যালট বাক্সে থাকায় গণনা পুনরায় যাচাই করার সুযোগ থাকবে। এ প্রযুক্তি ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত নয়, তাই হ্যাকিং বা কারসাজির ঝুঁকি নেই। ব্যালট ম্যানুয়ালি গণনার বিকল্প হিসেবে থাকবে, যাতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
নিরাপত্তা ও প্রশাসনের কাঠামো : ডিসি, এসপি, ইউএনওদের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিতে হবে।
বেসামরিক প্রশাসনের পরিবর্তে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবে সেনাবাহিনী, যাদের অধীনে রিটার্নিং অফিসার হবেন একজন ব্রিগেডিয়ার বা কর্নেল পদমর্যাদার। প্রিজাইডিং অফিসার হবেন মেজর বা ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার। পোলিং অফিসার হবেন সেনাবাহিনীর এনসিও সদস্য ও স্থানীয় শিক্ষক/কর্মচারী। ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকবে পুলিশ, আনসার ও বিজিবি। তারা সরাসরি সেনা কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করবেন। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সেনাবাহিনী কতটা নিরপেক্ষ থাকবে? আমরা আশাবাদী, কারণ অতীতে যেমন তারা ভোটার আইডি প্রকল্পে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তেমনি বিদেশেও শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন সুনামের সাথে। তা ছাড়া নির্বাচনে যারা দায়িত্বে থাকবেন, তারা ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল বা মেজর স্তরের কর্মকর্তা, তাদের সাধারণত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে না। এটি স্বল্পমেয়াদি একটি দায়িত্ব, যেখানে নিরপেক্ষতা হারানোর ঝুঁকি কম। এ স্বল্পসময়ে দুর্নীতির নেক্সাস গড়ে ওঠার আশঙ্কা খুব ক্ষীণ। নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনে রাখতে হবে, বদনাম হলে শুধু চাকরি নয়, বিদেশী মিশনের সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হবেন।
ধাপে ধাপে ভোট : ভোট এক দিনে না নিয়ে, আট বিভাগে আট দিনে করা যেতে পারে। এতে লোকবল কম লাগবে এবং একই স্ক্যানিং মেশিন পুনর্ব্যবহার করা যাবে। ভোট গ্রহণ শেষে এক দিনে সারা দেশের নির্বাচনী ফল ঘোষণা সম্ভব, যেমনটি আমাদের পাশের দেশ ভারতে হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা
দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের পর্যাপ্ত উপস্থিতি থাকবে। ধাপে ধাপে ভোট হলে পর্যবেক্ষকদের পক্ষে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সহজ ও কার্যকর হবে। সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে, যেমন অতীতে তত্ত¡বধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনে সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বাড়তি পাওনা হিসেবে আমাদের সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ আরো বাড়তে পারে। তাই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা রাখা দরকার।
রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে কঠোর আইন
আমরা একটি নতুন আইন প্রস্তাব করছি, রাজনৈতিক সভা-মিছিল বা প্রতিদ্ব›দ্বী দলের ওপর হামলায় কেউ নিহত বা গুরুতর আহত হলে, শুধু হামলাকারীর শাস্তি নয়, তার নেতারও পরবর্তী ১০ বছর নির্বাচন করার অধিকার থাকবে না। এ নিয়ম কার্যকর হলে সহিংস রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে। এটি রাজনৈতিক সহিংসতা রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
শেষ কথা : প্রশাসন ও পুলিশের দলীয় প্রভাব দূর না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ সঙ্কটে সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি জাতিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে এগিয়ে নিতে পারে। সেই সাথে ব্যালট স্ক্যানিং প্রযুক্তি স্বচ্ছতা ও আস্থার নতুন দিগন্ত খুলবে। আর রাজনৈতিক সহিংসতার নেতৃত্বকারীরা রাজনৈতিক মূল্য দিতে বাধ্য হলে, তা সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সুসম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় রাজস্ব বিভাগ; মানবাধিকারকর্মী, কানাডা প্রবাসী